বেহাল ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক। নিজস্ব চিত্র
গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা গুলির বেহাল দশা। দীর্ঘদিনের অবহেলার কারণে মুর্শিদাবাদ জেলা জুড়ে আকছাড় ঘটছে পথ দুর্ঘটনা। তার জেরে প্রতিদিন বাড়ছে হতাহতের সংখ্যাও।
কিন্তু ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক বা জেলার বিভিন্ন প্রান্তের রাজ্য সড়ক সংস্কারে জেলা প্রশাসন নির্বিকার। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ কোনও ভাবেই ঘুম ভাঙছে না কর্তৃপক্ষের। একই ভাবে এলাকার বাসিন্দারা আঙুল তুলছেন রাজনৈতিক দলগুলির দিকেও। তাঁদের অভিযোগ অন্য যে কোনও বিষয়ে নিয়ে রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা চটপট আন্দোলনে নেমে পড়েন। কথায় কথায় বিক্ষোভ, রাস্তা অবরোধ লেগেই রয়েছে। কিন্তু দুর্দশাগ্রস্ত রাস্তাগুলোর হাল ফেরানোর দিকে কোনও নজর নেই। ক্ষোভ বিক্ষোভ, সবই যেন দুর্লভ।
পরিসংখ্যান বলছে গত ২০ দিনে পথ দুর্ঘটনায় জখম হয়ে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন প্রায় ৩০ জন রোগী। মৃত্যু হয়েছে বেশ কয়েক জনের।
গত ২১ অক্টোবর সকালে দু’টি পৃথক দুর্ঘটনায় মারা যান দু’জন। বহরমপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে মোটরবাইক দুর্ঘটনায় জানেরা বিবি এবং ওই দিনই সন্ধ্যায় পঞ্চাননতলার কাছে মারা যান জয়ন্ত ভট্টাচার্য।
এ প্রসঙ্গে জেলা পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলেন, এই মুহূর্তে পরিসংখ্যান দেওয়া সম্ভব না হলেও, এ কথা সত্যি যে বিভিন্ন জাতীয় সড়কের উপর দুর্ঘটনা বাড়ছে। এ বিষয়ে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হচ্ছে পুলিশ প্রসাশনের পক্ষ থেকে।
মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার তথা সহ-অধ্যক্ষ মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায়ও মনে করেন ইদানীং সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে হাসপাতালে। তিনি বলেন, “৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের বেহাল দশার কারণেই পথ দুর্ঘটনা বাড়ছে। তবে হতাহতের সংখ্যাটা ঠিক কত তা এখানে বসে বলা সম্ভব নয়। কারণ বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে শুধুমাত্র গুরুতর জখম রোগীদেরই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। বাকিদের খবর হয়ত আমরা জানিই না।”
শুধু তাই নয়, প্রায় প্রতিদিনই ঘটে যায় ছোটখাটো সাইকেল বা মোটর বাইক দুর্ঘটনা। প্রাণহানির খবর না থাকলে তা নজরে আসে না। প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বিকল হয়ে যায় অসংখ্য গাড়ি। সে সব হিসাবই বা ক’জন রাখে?
কিন্তু সত্যিই কেমন আছে জেলার রাস্তাগুলো? একটু ঘোরাফেরা করলেই বেশ বোঝা যাবে তাদের হাল হকিকত্।
বহরমপুরের বুকের উপর দিয়ে চলে যাওয়া জাতীয় সড়ক আদৌ ধারে কাটে না। তবে তার ভার আছে বেশ। সর্বাঙ্গে ক্ষত নিয়েও হাজার হাজার মানুষের দুরপাল্লার এই পথ শুয়ে আছে অসহায়। কর্তৃপক্ষ হয়ত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য শূন্যের বেশি নম্বর পাবেন না ৩৪ নম্বর ওই জাতীয় সড়কে।
রাস্তা জুড়ে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। পিচের চাদর ভেঙে গিয়েছে অনেক দিন। তার উপর সর্বক্ষণ চলছে ভারী ট্রাক। ফলে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে বিছিয়ে পড়ে থাকে ভাঙা পাথরের টুকরো। গত বর্ষার জলে খানা-খন্দ পুকুরে পরিণত হয়েছিল। এখনও শুরু করা যায়নি সংস্কারের কাজটুকুও। কোথাও আবার পাহাড়ি রাস্তার মত জাতীয় সড়ক চড়াই-উতরাইয়ে পরিণত হয়েছে।
৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের মত অবহেলায় পড়ে রয়েছে বিভিন্ন রাজ্য সড়কও। পুলিশ প্রশাসনের সূত্রের খবর, রাস্তার বেহাল দশার কারণে আগের তুলনায় জেলায় পথ দুর্ঘটনার সংখ্যাও বেড়েছে।
জাতীয় সড়ক, রাজ্য সড়কের পাশাপাশি পুজোর বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই বহরমপুর পুরসভার বিষ্ণুপুর রোডের হালও খুব খারাপ। পুজোর ঠিক আগে কোনও ভাবে রাস্তায় তাপ্পি মারার কাজ করে বহরমপুর পুর-কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ওই রাস্তায় প্রতি দিন কয়েক হাজার ভারী পণ্যবাহী লরি-বাস চলাচলের ফলে এখন রাস্তা আগের চেহারায় ফিরে গিয়েছে। কংগ্রেস পরিচালিত পুর-কর্তৃপক্ষ অবশ্য নির্বিকার! রাস্তা সংস্কারের বিষয়ে পুর-কতৃর্পক্ষের উদাসীনতাকেই দায়ি করেছেন বহরমপুরের বাসিন্দারা। যদিও ওই রাস্তার উপরেই পণ্যবাহী লরি চালকদের কাছ থেকে ‘ট্যাক্স’ আদায় হয়ে থাকে।
অন্য দিকে পঞ্চাননতলা থেকে চুনাখালি মোড় পর্যন্ত বহরমপুর-জলঙ্গি রাজ্য সড়ক, বহরমপুরের রাধারঘাট থেকে কান্দি হয়ে কুলি মোড় পর্যন্ত রাজ্য সড়কের ভগ্নদশা! পূর্ত দফতরের (বহরমপুর ডিভিশন-১) নির্বাহী বাস্তুকার আজফার আলি বলেন, “বহরমপুর রাধারঘাট মোড় থেকে কুলি পর্যন্ত সাড়ে ৩৪ কিমি রাস্তা সারাইয়ের ব্যাপারে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ভারী পণ্যবাহী লরি থেকে প্রতি দিন ওই রাস্তায় যে হারে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে অবিলম্বে রাস্তা সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।” ওই রাস্তা মেরামতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে পূর্ত দফতর। আজফারবাবু জানান, “সমীক্ষা করে ডিপিআই (ডিটেলস্ প্রজেক্ট রিপোর্ট) জমা দেওয়ার জন্য কোটেশন আহ্বান করা হয়েছে। আগামী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে ওই কোটেশন জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ডিপিআই তৈরি করে জমা দেওয়ার পরে অনুমোদন পেলেই ওই রাস্তা সংস্কার করা হবে। তার আগে রণগ্রাম সেতু থেকে পুরন্দরপুর পর্যন্ত, কান্দি-কুলি রাজ্য সড়কের বেশ কিছু অংশ সারাইয়ের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।” অন্য দিকে পূর্ত দফতরের (বহরমপুর ডিভিশন-২) নির্বাহী বাস্তুকার প্রণব বিশ্বাস বলেন, “বহরমপুর-জলঙ্গি রাজ্য সড়কের পঞ্চাননতলা থেকে চুনাখালি পর্যন্ত এবং বহরমপুর-জিয়াগঞ্জ রাজ্য সড়কের মধ্যে বেশ কিছু রাস্তা অবিলম্বে সংস্কার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।”
তবে বহরমপুরের বুক চিরে চলে যাওয়া ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের মধ্যে সব থেকে ভয়ঙ্কর অবস্থা গির্জার মোড় থেকে ভাকুড়ি পর্যন্ত। জাতীয় সড়কের পিচের চাদ উঠে গিয়ে বড় বড় গর্ত হয়ে গিয়েছে। রাস্তার মাঝে প্রায় আড়াই থেকে তিন ফুট পর্যন্ত গর্ত। তার উপর দিয়ে পণ্যবাহী বড় বড় লরি পাহাড়ি রাস্তায় চলার মত চড়াই-উতরায় পেরিয়ে এঁকে-বেঁকে যাচ্ছে। রাস্তার কারণে যেখানে-সেখানে লরি বিকল হয়ে পড়ে থাকছে। ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটির মালদা ডিভিশনের প্রকল্পর আধিকারিক মহম্মদ সাইফুল ‘অবিলম্বে রাস্তা সংস্কার করা হবে’ বলে আশ্বাস বাণী শোনালেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
দীর্ঘ দিন ধরে জাতীয় সড়ক সংস্কার না হওয়ায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রতিবাদ-আন্দোলন সংগঠিত করেছে। পথ অবরোধও হয়েছে। কিন্তু রাস্তার হাল ফেরেনি! সিপিএমের জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য বলেন, “৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক দিয়ে যাতায়াত এখন নরক যন্ত্রণার সামিল। আন্দোলন হচ্ছে না, তা নয়। সমস্ত রাজনৈতিক দলই পথ অবরোধের কর্মসূচিতে সামিল হয়েছে। কিন্তু জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের কোনও হেলদোল নেই। তাদের উদাসীনতা এবং গাফিলতির কারণেই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। রাজ্য সরকারও নির্লিপ্ত। জনগণের প্রতি এই সরকারের কোনও দায়বদ্ধতা নেই বলেই সরকারি স্তরে কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।” জেলা কংগ্রেসের মুখপাত্র অশোক দাস বলেন, “সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক ভাবে চলাচল করবে জাতীয় সড়কের এমন অবস্থা নেই। জাতীয় সড়ক সংস্কারের রাজ্য সরকারের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের উদাসীনতাও রয়েছে। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ মানুষকে পথে বের হচ্ছে। রাস্তার ভগ্নদশার কারণে পথ-দুর্ঘটনাও বাড়ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy