জঙ্গিপুরে হয়েছে। বাকিদের কবে? —নিজস্ব চিত্র।
ঢিলেমিটাই সমস্যা। কখনও কাজে ঢিলেমি ঠিকাদারি সংস্থার। কখনও সই-সাবুদে ঢিলেমি প্রশাসনের। হাজারো গড়িমসিতে থমকে মুর্শিদাবাদে প্রায় ৯০টি জলপ্রকল্পের কাজ। সেই মুর্শিদাবাদে, যেখানে কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রকের হিসেবে ১২১৮টি গ্রামের ৪০ লক্ষেরও বেশি মানুষ আর্সেনিকপ্রবণ এলাকার বাসিন্দা২৬টির মধ্যে ১৯ ব্লকই আর্সেনিকপ্রবণ। কেন্দ্রীয় সরকারের হাজারো সতর্কতা সত্ত্বেও ভূপৃষ্ঠের জল অর্থাৎ ‘সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে’র কাজ সেভাবে এগোয়নি মুর্শিদাবাদে। ভূগর্ভস্থ জলপ্রকল্পের কাজগুলিও অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
২০০৭ সালে কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রক মুর্শিদাবাদের ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিক প্রবণতা নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। রিপোর্টে ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে ‘রিস্ক জোন’ হিসেবে ১০টি ব্লককে (রঘুনাথগঞ্জ ১ ও ২, সুতি ১, বেলডাঙা ১ ও ২, ফরাক্কা, কান্দি, সামশেরগঞ্জ, রানিনগর ২ ও খড়গ্রাম) চিহ্নিত করে তারা। রিপোর্টে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়, ওই ১০টি ব্লকের কোথাও গভীর নলকূপের জল ছাড়া কোনও জলই পানীয় হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। ভরতপুর ২ ব্লকে ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার নিষিদ্ধ বলে ওই রিপোর্টে জানানো হয়। জেলার বাকি১৫টি ব্লককে ‘সেমি-ক্রিটিক্যাল’ চিহ্নিত করে খুব সতর্ক ভাবে সেখানে গভীর নলকূপ বসানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রকের এই সতর্কবার্তা সত্ত্বেও জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতর জেলার ৫৬ শতাংশ মানুষের কাছে এখনও পর্যন্ত আর্সেনিকমুক্ত পরিশ্রুত পানীয় জল পৌঁছে দিতে পারেনি। জেলার জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এই মুহূর্তে মুর্শিদাবাদ জেলার গ্রামীণ এলাকার ৪৮.৮৮ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ৩৯.২৭ শতাংশ মানুষের কাছে পাইপ লাইনের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানীয় জল পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। বাকিদের সম্বল নলকূপের জল।
এখন মুর্শিদাবাদে জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের আওতায় ৮৮টি ভূগর্ভস্থ জলপ্রকল্পের কাজ চলছে। প্রায় ২৫৬ কোটি ৭৪ লক্ষ টাকার ওই প্রকল্পগুলি শেষ হলে ১৬ লক্ষেরও বেশি মানুষ উপকৃত হবেন। দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ৮৮টি প্রকল্পের মধ্যে ৩৩টির কাজ শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালে। বাকি ৫১টি ২০০৮ ও ২০০৯ থেকে চলছে। ৬-৭ বছরেও সেগুলি শেষ করা গেল না কেন? জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের মুর্শিদাবাদ জেলার এক আধিকারিকের দোহাই, “কোনওটির জমি পেতে সমস্যা হয়েছে, কোনওটিতে ঠিকাদার নিয়োগ নিয়ে জটিলতা, কোথাও পঞ্চায়েত থেকে গড়িমসি হয়েছে।” ওই আধিকারিকের আশ্বাস, “খড়গ্রামের ভালকুণ্ডিতে ৭ কোটি ১৪ লক্ষ টাকার যে কাজ চলছে, সেটি শেষ হয়ে যাবে জুলাইয়ের মধ্যে। এছাড়াও ভরতপুরের টেঁয়া, লালগোলার বনসাগর, জঙ্গিপুরের পুঁটিয়া, বেলডাঙার কাশিপুর, ডোমকলের জুরানপুর, সামশেরগঞ্জের ভাসাইপাইকর প্রভৃতি আর্সেনিকপ্রবণ এলাকাগুলিতেও জলপ্রকল্পের কাজ এ বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।” এগুলো হয়ে গেলে মুর্শিদাবাদের জল সমস্যা অনেকটাই মিটে যাবে বলে দাবি ওই আধিকারিকের। তিনি জানান, এছাড়াও সাগরদিঘির কাবিলপুর, দস্তুরহাট, জলঙ্গির সাহেবরামপুর, কৃত্যায়নিপাড়া-সহ ১৩টি গ্রামে ১৩টি জল প্রকল্প গড়ার প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে রাজ্য সরকারের কাছে। সব মিলিয়ে জেলায় এ বছরের শেষে গ্রাম-শহর মিলিয়ে ৭১ লক্ষ বাসিন্দার মধ্যে ৮৭.৩২ শতাংশ মানুষ আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জল পরিষেবার আওতায় চলে আসবে বলে দাবি জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের।
যদিও গত কয়েকবছরের অভিজ্ঞতায় দফতরের সেই আশ্বাসে ভরসা নেই জেলাবাসীর। সুতির তৃণমূল বিধায়ক ইমানি বিশ্বাস বলেন, “সরকারি লোকজন যাই বলুন না কেন, জলপ্রকল্পের কাজে কোনও গতি নেই। এই ভাবে কাজ চললে এক মাস তো দূর, পুরো বছরেও কাজ শেষ করা যাবে না। জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের এই ঢিলেমির কথা বিধানসভাতে তুলেছি। আর্সেনিকপ্রবণ জেলায় জলপ্রকল্প নির্মাণে যতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত, ততটা হচ্ছে না।”
মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক ওয়াই রত্নাকর রাও বলেন, “এতগুলো প্রকল্পের কাজ কেন হয়নি, খোঁজ নিয়ে দেখছি।”
বিজ্ঞানীরা অবশ্য মনে করেন, আর্সেনিকপ্রবণ এলাকায় ভূগর্ভস্থ জলের চেয়েও ভৃপৃষ্ঠস্থ জলের ব্যবহার বেশি করা উচিত। আর্সেনিক গবেষক শীর্ষেন্দু শুকুলের মতে, ভয়াবহ আর্সেনিকের দূষণ থেকে মুক্তির প্রধান উপায় হল ভূপৃষ্ঠের জল অর্থাৎ মাটির উপরের জল ব্যবহার সুনিশ্চিত করা। সেই সঙ্গে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করে তা ব্যবহার করা। দু’টি উৎসের জলই নিরাপদ এবং আর্সেনিক মুক্ত। মুর্শিদাবাদ জেলাতে কয়েকটি সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের কাজ চলছে অবশ্য। এর মধ্যে বহরমপুর, রঘুনাথগঞ্জ, বেলডাঙা, মুকুন্দপুরএই চারটি সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের কাজ শেষ হলেও খুব কম এলাকার লোক উপকৃত হয়েছে তাতে। সাগরদিঘি ও ফরাক্কার বেনিয়াগ্রামের কাজ এখনও শেষ হয়নি।
আর্সেনিকপ্রবণ জেলায় ভূপৃষ্ঠস্থ জলপ্রকল্পের সংখ্যা এত কম কেন? জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের আধিকারিক জানান, এই প্রকল্পগুলিতে অনেক বেশি টাকা বরাদ্দ করতে হয় বলে সংখ্যায় কম। এ ছাড়াও নদীভিত্তিক এই জলপ্রকল্পগুলি তৈরির ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা কাছেপিঠে জলের উৎস পাওয়া। সেক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলের নদী-খাল বা বড় জলাশয়কে ব্যবহার করে মুর্শিদাবাদের গ্রামে-গ্রামে এই ধরণের জল প্রকল্প গড়ার উপর জঙ্গিপুরের সাংসদ থাকাকালীন গুরুত্ব দিতে বলেছিলেন প্রণব মুখোপ্যাধ্যায়। রঘুনাথগঞ্জের কংগ্রেস বিধায়ক আখরুজ্জামান বলেন, “গোসাবা, বসিরহাট, হাসনাবাদ-সহ বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ১৭টি এই ধরনের প্রকল্প গড়া হয়েছে। মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি-সহ বিভিন্ন এলাকায় বিশাল পুকুর রয়েছে। ১০০ দিনের কাজে পুকুরের গভীরতা বাড়িয়ে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করে এই ধরনের ছোট ছোট পানীয় জল প্রকল্প গড়ার জন্য প্রণববাবু রাজ্য সরকারের কাছে বহু বার প্রস্তাব দিয়েছেন। এগুলি তৈরি করা গেলে মুর্শিদাবাদের আর্সেনিক কবলিত বহু এলাকার মানুষ আর্সেনিক-মুক্ত পানীয় জল পেতে পারতেন। অন্য কয়েকটি জেলায় এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত করা হলেও আর্সেনিক অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদে তার কোনও চেষ্টাই হয়নি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy