Advertisement
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪

শ্বশুরকে যকৃত দিলেন বৌমা

যখন চার পাশের সব সম্ভাবনার আলো নিভে যাচ্ছে তখন তাঁর বড় বৌমা জাহানারা নিজের যকৃতের অংশ শ্বশুরমশাইকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করেননি।

সুলতান মল্লিক ও জাহানারা। নিজস্ব চিত্র

সুলতান মল্লিক ও জাহানারা। নিজস্ব চিত্র

সুস্মিত হালদার
শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:৪৬
Share: Save:

পরের বাড়ির মেয়ে তাঁর সংসারে এসে সবাইকে আপন করে নিয়ে থাকবে, এ আশা তাঁর ছিল। যেমন আর পাঁচ জন শ্বশুরমশাইয়ের থাকে। বউমা একটু গরম চা এগিয়ে দেবে, ভালমন্দ রেঁধে খাওয়াবে, মিষ্টি কথা বলবে, এতো সকলেই চান। কিন্তু এই মেয়ে যে সব কিছু ছাপিয়ে নিজের শরীরের অংশ কেটে দিয়ে তাঁর প্রাণ বাঁচাবে, এমন কল্পনাও করতে পারেননি নদিয়ার চাপড়ার এলেমনগর গ্রামের সুলতান মল্লিক!

যখন চার পাশের সব সম্ভাবনার আলো নিভে যাচ্ছে তখন তাঁর বড় বৌমা জাহানারা নিজের যকৃতের অংশ শ্বশুরমশাইকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করেননি। বাপের বাড়ি থেকে হালকা আপত্তি এলেও তা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। গত সোমবার ২০ ঘণ্টা ধরে হয়েছে অস্ত্রোপচার। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, অস্ত্রোপচার সফল। বেঙ্গালুরুর হাসপাতাল থেকে সে কথা জানাতে গিয়ে আবেগে গলা বুঁজে আসছিল সুলতানের। বলছিলেন, ‘‘কথায় বলে, বৌমা হল মেয়ের মতো। সেই জন্য তাঁরাও শ্বশুরকে ‘বাবা’ বলে। কিন্তু এ বার তো ওর শরীরের অংশ ধার করে আমাদের বাবা-মেয়ের মধ্যে সত্যিকারের রক্তের বন্ধন তৈরি হল। এমন বৌমা লোকে ভাগ্য করে পায়।’’

শ্বশুরবাড়িতে বধূর নির্যাতিত হওয়া, বধূহত্যা এবং উল্টোপিঠে বৌমার হাতে বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ির হেনস্থার খবর প্রায় প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে মেলে। সেখানে ইতিবাচক ব্যতিক্রমের নজির হয়ে উঠেছে সুলতান ও জাহানারার বৃত্তান্ত।

বছর পঞ্চান্নোর সুলতান মল্লিক পেশায় ছিলেন গাড়িচালক। বছর তিনেক আগে তাঁর যকৃতের সমস্যা ধরা পরে। কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা চলতে থাকে। কিন্তু অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাঁকে দক্ষিণ ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর বড় ছেলে আশিস বলছেন, “হায়দরাবাদ, চেন্নাই ও বেঙ্গালুরুর তিনটি হাসপাতাল থেকেই আমাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, বাবার যকৃতে টিউমার হয়েছে। দ্রুত লিভার প্রতিস্থাপন করতে হবে।” প্রথমে তাঁর তিন ছেলেকে পরিক্ষা করা হয়। কিন্তু চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, একমাত্র বড় ছেলের সঙ্গেই রক্তের গ্রুপ ম্যাচ করেছে। কিন্তু সেই ছেলের ‘ফ্যাটি লিভার’ হওয়ার কারণে তাঁর যকৃৎ কাজে লাগবে না। তখন যোগাযোগ করা হয় বেশ কয়েক জন আত্মীয়ের সঙ্গে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি।

তখনই সবাইকে অবাক করে প্রস্তাবটা দেন বাড়ির বড় বউ— “আমার যকৃতে কাজ হবে না? যদি হয় তা হলে আমিই দেব।’’ প্রথমে শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন সবাই। তার পরই শুরু হয় তোড়জোড়। মিলে গিয়েছিল রক্তের গ্রুপও। পরিবার সূত্রের খবর, বেঙ্গালুরুর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও প্রথমে শুনে বিশ্বাস করতে চাননি যে, বউমা শ্বশুরমশাইকে যকৃৎ দিতে চেয়েছেন। প্রথমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিশ্বাসই করতে চায়নি যে, বৌমা স্বেচ্ছায় শ্বশুরকে লিভার দিতে রাজি হয়েছেন। জেলা পুলিশের রিপোর্ট দেখার পর তাঁরা আশ্বস্ত হন। জাহানারার পাশাপাশি তাঁর বাপের বাড়ির সকলের সঙ্গেও চিকিৎসকেরা কথা তার পর বেঙ্গালুরুর ওই হাসপাতাল লিভার প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।

জাহানারার আপ্লুত স্বামী আশিস বলেন, ‘‘বারো বছর হল আমাদের বিয়ে হয়েছে। সন্তানও রয়েছে। কিন্তু এই ঘটনায় ওকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করলাম। সারাজীবন ওর কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।’’ যাঁকে নিয়ে এতকিছু সেই অষ্টম শ্রেণি পাশ গৃহবধূটি কিন্তু শান্ত গলায় হাসপাতালের শয্যা থেকে টেলিফোনে বলেছেন, ‘‘বাবা অনেক কষ্ট করে আমাদের সংসারকে দাঁড় করিয়েছেন। তিনি বেঁচে থাকলে গোটা সংসার সুখে থাকবে। আমি যা করেছি সংসারের ভালর জন্য করেছি।”

অন্য বিষয়গুলি:

Health Organ Donation Liver Transplant
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy