Advertisement
E-Paper

‘বাজিগ্রাম’ নতুন চাঁদরা অপেক্ষায় সাজা ঘোষণার

টারজন শেখের দুই ছেলে সামিম ও আবিরের মৃত্যু হয়েছিল এই বিস্ফোরণে। দুর্ঘটনার পরে গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে বাড়ি করেছেন তিনি।

শোক কাটেনি নতুন চাঁদরায়। 

শোক কাটেনি নতুন চাঁদরায়।  —নিজস্ব চিত্র।

বিমান হাজরা

শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০২৩ ০৮:০৯
Share
Save

মুর্শিদাবাদের সুতি থানার ‘বাজিগ্রাম’ নতুন চাঁদরা এখন শুনশান। পিংলার বিস্ফোরণ কাণ্ডে নিহত ১৩ জনের মধ্যে এই গ্রামেরই বাসিন্দা ছিলেন ১০ জন। তিন জন ছাড়া সকলেরই বয়স ১০ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। ঘটনার ৮ বছর পরেও সেই শোক এখনও স্মৃতি হয়ে ফিরে আসে বহু পরিবারেই। আজ সোমবার সেই সাজা ঘোষণা হবে শুনেও অবশ্য নির্বাক তাঁরা। প্রশ্ন, সেই ছেলেরা কি আর তাতে ঘরে ফিরবে ?

নিমতিতা রেল-গেট থেকে দক্ষিণে রেল-লাইন বরাবর মাইল দেড়েক গেলেই নতুন চাঁদরা। কেউ বলেন জয়বাংলা গ্রাম। দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরির শর্তে পূর্ব মেদিনীপুরের পিংলায় বাজি কারখানায় কাজে গিয়েছিল এই গ্রামেরই ১৩ কিশোর। প্রায় ১২০ ঘরের ওই গ্রাম এখনও ভুলতে পারেনি পিংলার ভয়াবহ সেই বিস্ফোরণে কথা।

টারজন শেখের দুই ছেলে সামিম ও আবিরের মৃত্যু হয়েছিল এই বিস্ফোরণে। দুর্ঘটনার পরে গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে বাড়ি করেছেন তিনি। ছেলে লালুর মৃত্যুর পর গ্রাম ছেড়েছেন দিলসাদ শেখের পরিবারও। গ্রাম ছেড়েছেন মৃত রাহুল শেখের পরিবারও। ছেলের মৃত্যুর পর গ্রাম ছেড়ে গিয়েছেন লালচাঁদ শেখও। কিন্তু গ্রাম ছেড়ে যেতে পারেননি বিস্ফোরণে মৃত জহিরুদ্দিন শেখের মা সেলিনা বেওয়া। স্বামী রবিউল শেখও বাজি কারখানায় কাজে গিয়েই মারা গিয়েছিল পিংলার ঘটনার বেশ কয়েক বছর আগে। তাঁদের ৭ ছেলেমেয়ে, সকলেই প্রায় নাবালক। জহিরুদ্দিন ছিল বড়। ছোট ভাই বছর ১২ বয়সের মোস্তাককে নিয়ে পিংলায় গেছিল সে। ঘটনার সময় মোস্তাক শৌচাগারে থাকায় বেঁচে গিয়েছিল। আদালতে সে দিনের সমস্ত ঘটনায় জানিয়ে এসেছে মোস্তাক। মা সেলিনা বেওয়া বলেন, ‘‘মোস্তাক এখন ওড়িশায় রাজমিস্ত্রির কাজে গেছে। সংসার চলছে কোনওরকমে।পিংলার ঘটনায় সাজা হলে আমার ছেলে জহিরুদ্দিন কি আর ফিরবে? যারা মারা গিয়েছিল তাদের ২ লক্ষ টাকা করে সাহায্য দিয়েছিল সরকার। আমি সেটাও পাইনি। সেটা পেলে অন্তত মেয়ের বিয়েটা দিতে পারতাম।’’

দীর্ঘ দিন ধরে অরঙ্গাবাদ লাগোয়া এই গ্রামটি বাজি তৈরির জন্য পরিচিত। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে মেয়ে, কিশোরেরাও এক সময় হাত লাগাত বাজি তৈরিতে। তাই বাজি তৈরির জন্য কারিগর হিসেবে সর্বত্র যাতায়াত ছিল এই গ্রামের লোকজনের। সেই খোঁজেই গাড়ি হাঁকিয়ে মেদিনীপুর থেকে বাবুরা প্রায়ই আসতেন নতুন চাঁদরায়।

দাবি, ৫০০ টাকা মজুরির লোভ দেখিয়েই ‘ছেলে ধরতেন’ তাঁরা গ্রামে এসে। সেই সঙ্গে মুফতে থাকা খাওয়া। কখনও দশ-বারো দিনের টানা কাজ, কখনও বা মাসখানেকের কাজে মোটা টাকার লোভ। দিতেন অগ্রিম মোটা টাকাও। সেই লোভের ফাঁদে পা দিয়েই ওরা গিয়েছিল মাইতিবাবুর পিংলার বাড়িতে। নতুন চাঁদরায় বাড়ি ফিরত যখন, তখন পকেট বোঝাই টাকা।

বছরে কেউ তিন বার, কেউ চার বার মেদিনীপুরে কাজে যেত। গ্রামেরই একাংশের দাবি, গ্রামের বেশির ভাগ পরিবার টাকার জন্যই সন্তানদের ছেড়েও দিতেন। কেউ জিজ্ঞেস করলে পরিবারের লোকজন রাজমিস্ত্রির গল্পই শোনাতেন। ফলে মাইতিবাবুদের গ্রামে আনাগোনা নিয়ে কারও সন্দেহও হয়নি। তাঁর কথাতেই কাজে গিয়েছিল গ্রামের ১৩ জন। ফিরে আসার কথা ছিল জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ইদের আগে। কিন্তু ৬ মে রাতে বিস্ফোরণের খবর বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল মুর্শিদাবাদের এই গ্রামকে। এখানে বিড়ি বেঁধে ১০০ টাকা রোজগার। তাই ৫০০ টাকা ও খাওয়া দাওয়ার টোপ দেখিয়েই ওদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

বাড়তি পয়সার লোভেই ঝুঁকি নিয়েই কাজে গিয়ে গ্রামে ফিরেছিল তাদের ছিন্নভিন্ন দেহ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bomb Explosion

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}