বিজয়োল্লাস। ছবি-প্রণব দেবনাথ।
ভোট ঘোষণা ইস্তক বিজেপি নেতারা যে ভাবে মাটি কামড়ে পড়েছিলেন, অনেকেরই মনে হচ্ছিল, করিমপুরে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। বিশেষ করে বাম-কংগ্রেস জোট যদি নিজের ভোট ধরে রাখতে না পারে, যে সম্ভাবনা আগাগোড়াই প্রবল ছিল।
বৃহস্পতিবারের ফলে স্পষ্ট, সেই হিসেব মেলেনি, আবার মিলেওছে। মে মাসের লোকসভা নির্বাচন তো বটেই, ২০১৬-র বিধানসভা ভোটের তুলনায় ব্যবধান অনেকটাই বাড়িয়ে জিতেছেন তৃণমূল প্রার্থী বিমলেন্দু সিংহ রায়। তবে জয়প্রকাশ মজুমদার হারলেও পাঁচ হাজারেরও বেশি ভোট বেড়েছে বিজেপির। প্রবল মেরুকরণের ভোটে প্রায় তলিয়ে গিয়েছে তৃতীয় পক্ষ বাম-কংগ্রেস জোট। প্রকৃত পক্ষে, বাম ভোট নিজের ঝুলিতে পুরেই এত দিন করিমপুরে বেড়েছে বিজেপি। কিন্তু এ বার যে লাভের গুড় তৃণমূলই বেশি খেয়ে গেল, তার কারণ সম্ভবত বাম নয়, খোয়া গিয়েছে কংগ্রেসের ভোট।
গত লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকেই করিমপুরে ধর্মীয় মেরুকরণের ছবিটা স্পষ্ট হচ্ছিল। সে বারই তুলনায় বেশি হিন্দু অধ্যুষিত করিমপুর ১ ব্লক থেকে ১০ হাজারের কাছাকাছি লিড পেয়েছিল বিজেপি। মুসলিম-প্রধান করিমপুর ২ ব্লকে প্রায় ২৪ হাজার ভোটে এগিয়ে ছিল তৃণমূল।
গত ছ’মাসে সেই প্রবণতার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। বরং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এনআরসি-ভীতি আর আর্থিক মন্দা। বিজেপির স্থানীয় নেতারা প্রচার পর্বে এনআরসি নিয়ে বিশেষ মুখ খোলেননি ঠিকই, কিন্তু দলের শীর্ষ নেতারা তর্জন-গর্জন চালিয়েই গিয়েছেন। উল্টো দিকে, তৃণমূল এবং বাম-কংগ্রেস জোট ঘরে-ঘরে পাড়ায়-পাড়ায় বুঝিয়ে গিয়েছে, এনআরসি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে।
তার ফল হয়েছে হাতেনাতে। এ বার করিমপুর ২ ব্লক থেকে প্রায় ২৮ হাজার ভোটের লিড পেয়েছে, অর্থাৎ মে মাসের তুলনায় প্রায় চার হাজার ভোটের ব্যবধান বেড়েছে। কিন্তু ১ নম্বর ব্লকে তাদের ক্ষতির বহর আগের বারের তুলনায় অনেকটাই কম, ১০ হাজারের জায়গায় মোটে চার হাজার মতো। দলগুলি এখনও ভোটের ফল পুরো বিশ্লেষণ করে উঠতে পারেনি। কিন্তু প্রাথমিক ভাবে একটা ইঙ্গিত মিলছে। তা হল, বিজেপির দিকে সরে যাওয়া হিন্দুদেরও একটা অংশ এনআরসি এবং মন্দা নিয়ে চিন্তিত। তাঁরা আর আগের মতো চোখ বুজে বিজেপির উপরে ভরসা রাখতে পারছেন না।
প্রত্যাশা মতোই, তৃণমূলের পালে সবচেয়ে বেশি হাওয়া জুগিয়েছে ২ নম্বর ব্লকের প্রবল সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ধোড়াদহ ১ ও ২, নতিডাঙা ১ ও ২ এবং রহমতপুর পঞ্চায়েত। আবার ১ নম্বর ব্লকে ভীষণ রকম হিন্দুপ্রধান করিমপুর ১ ও ২ ব্লকে তারা চোট পেয়েছে সবচেয়ে বেশি।
এ দিন গণনার শুরুতে প্রথম রাউন্ডেই ধোড়াদহ ১ পঞ্চায়েত থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার ভোটে এগিয়ে যায় তৃণমূল। দ্বিতীয় রাউন্ড শেষে সেই ব্যবধান গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় পনেরো হাজার ভোটে। ধোড়াদহ ১ ও ২ এবং নতিডাঙা ১ ও ২ মিলিয়ে বিজেপির থেকে প্রায় উনত্রিশ হাজার ভোট বেশি পায় তৃণমূল। লোকসভা ভোটে যা ছিল চব্বিশ হাজারের কাছাকাছি। করিমপুর ১ ব্লকে বিজেপি ভাল ফল করলেও লোকসভা ভোটের তুলনায় তা কম। বাম-কংগ্রেস আগের চেয়ে অনেক খারাপ ফল করা সত্ত্বেও। গত লোকসভা ভোটে যেখানে সিপিএম-কংগ্রেসের মিলিত ভোট ছিল প্রায় চল্লিশ হাজার মতো, এ বার তা কুড়ির নীচে নেমে এসেছে। ফলে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে প্রার্থী গোলাম রাব্বির। একটি মাত্র রাউন্ড ছাড়া তারা দু’হাজারের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। এক মাত্র ৩ নম্বর রাউন্ডে নতিডাঙা ১ ও ২ এলাকায় তাদের প্রাপ্ত ভোট ২৮৯৩, তিন হাজারের কাছাকাছি। সেখানে বিজেপি তলানিতে ঠেকেছে। করিমপুর ১ ও ২ পঞ্চায়েত এলাকা কিন্তু তাদের ভোট দেয়নি।
সিপিএম প্রার্থী গোলাম রাব্বির মতে, এই ভোটে এনআরসি-র প্রভাব পড়েছে। দেশ ছাড়তে হওয়ার আতঙ্কে বিশেষত সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূলের দিকে সরে গিয়েছে। কংগ্রেসের ভোট সে ভাবে সিপিএমে পড়েনি, এমনকি সিপিএমেরও কিছু ভোট এনআরসি-র কারণেই তৃণমূলের দিকে চলে গিয়ে থাকতে পারে। নতিডাঙা এলাকায় সিপিএমের ভাল সংগঠন আগেও ছিল এবং সেই কারণেই সেখানে নিজেদের শক্তি কিছুটা ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। রাব্বির আক্ষেপ, “ধর্মের রাজনীতির কাছে আমরা পরাজিত হয়েছি।”
করিমপুর ১ ব্লক তৃণমূল সভাপতি তরুণ সাহা বলেন, “ভোটের ফলাফল এখনও ভাল করে খতিয়ে দেখা হয়নি। তবে আগের ভোটে এই ব্লকে বিজেপি যতটা এগিয়ে ছিল, আমরা সেই ব্যবধান কমাতে পেরেছি। করিমপুর ১ ও ২ পঞ্চায়েত এলাকাতেও আমাদের ভোট বেড়েছে। উন্নয়নের কারণেই মানুষ আমাদের সমর্থন করেছেন।”
করিমপুর ২ ব্লকের ধোড়াদহ ২ পঞ্চায়েতের অঞ্চল সভাপতি বঙ্কিম মণ্ডল জানান, ওই এলাকায় সবচেয়ে বেশি প্রায় ন’হাজার ভোটে লিড পেয়েছে তৃণমূল, যা গত লোকসভা ভোটে প্রায় তিন হাজার। তাঁর দাবি, “আমরা প্রতিটি মানুষের কাছে গিয়েছি। তাঁদের অভিযোগ শুনে যতটা সম্ভব তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছি। এই ভোটে তার ফল পেলাম।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy