একুশে-যাত্রা: কৃষ্ণনগর স্টেশনে লোকাল ট্রেনের কামরা। রবিবার সকালে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
ক’দিন ধরেই আশঙ্কা করছিলেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। রবিবার সেই আশঙ্কা অনেকটাই সত্যি প্রমাণ হল। অন্য বারের তুলনায় ধর্মুতলাখী ভিড় অনেকটাই কম। হাতছাড়া হয়ে যাওয়া রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্র তো বটেই, জেলার অন্য অংশেও ছবিটা বিশেষ আশাব্যঞ্জক নয়।
প্রথমত, অন্য বার যত বাস তৃণমূল কর্মীদের নিয়ে কলকাতায় সমাবেশে যায়, এ বার তার চেয়ে অনেক কম বাস গিয়েছে। তার উপর, বেশির ভাগ বাসে যাত্রীর সংখ্যাও ছিল অন্য বারের তুলনায় কম। যদিও এই দাবি কার্যত উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন তৃণমূল নেতারা। তাঁদের দাবি, ট্রেনেও প্রচুর কর্মী কলকাতায় একুশে জুলাইয়ের সমাবেশে গিয়েছেন।
করিমপুর থেকে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত কোনও রেললাইন নেই। কলকাতায় যেতে হলে বাসই ভরসা। তা ছাড়া ছোট গাড়ি। এই বিস্তীর্ণ এলাকায় কোনও বিকল্প পথ নেই। অথচ অন্য বারের চেয়ে এ বার অনেক কম বাস ভাড়া করা হয়েছে বলে নদিয়া জেলা বাস মালিক সমিতি সূত্রে জানা গিয়েছে। সংগঠনের পক্ষে অসীম দত্ত বলেন, “গত বছরেও প্রায় সাড়ে তিনশো বাস ভাড়া করা হয়েছিল। এ বার সেখানে মাত্র শ’খানেক বাস ভাড়া করা হয়েছে।” যেহেতু জেলার উত্তর অংশের অনেকটা রেলের আওতার বাইরে, এই পরিসংখ্যানই ছবিটা তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট দাবি বিরোধীদের।
শুধু তাই নয়। বাস শ্রমিকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, যে ক’টি বাস গিয়েছে, তার অনেকগুলিতেই যাত্রী ছিল অন্য বারের চেয়ে কম। জেলা তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “নাকাশিপাড়ি, কালীগঞ্জ বা ধুবুলিয়ার কর্মীরা না হয় ট্রেনে যেতে পারেন কিন্তু করিমপুর, চাপড়া, পলাশিপাড়া বা তেহট্টের লোকদের তো বাসে করেই যেতে হবে। আমরা কিন্তু প্রথম থেকেই বুঝতে পারছিলাম যে এমন কিছু একটা ঘটতে পারে।”
এত দিন ‘তৃণমূলের গড়’ বলে পরিচিত ছিল পুণ্ডরীকাক্ষ সাহা ওরফে নন্দ সাহার নবদ্বীপ। অনেকে বলছেন, অসুস্থ শরীরে এ বার নন্দ যে পরিশ্রম করেছেন তা সাম্প্রতিক কালে দেখা যায়নি। তার পরেও এ বারের একুশে জুলাই প্রমাণ করে দিল যে হাওয়া দিক পাল্টে ফেলেছে অনেকটাই। কারণ প্রতি বারের মত এ বারও নবদ্বীপ থেকে ট্রেনে কর্মীরা গেলেও সেই ভিড় ছিল না বলেই দাবি প্রত্যক্ষদর্শীদের একটা বড় অংশের। প্রায় একই ছবি কালীগঞ্জ, নাকাশিপাড়া, ধুবুলিয়ার।
কেন এমন হল?
তৃণমূলের অন্দরের একাংশের মতে, লোকসভা ভোটে ধাক্কা খাওয়ার পরে বহু কর্মীই আর তেমন উৎসাহ পাচ্ছেন না। তা ছাড়া, কলকাতায় যাওয়ার জন্য দল থেকে এ বার কোনও আর্থিক সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। সব খরচ বহন করতে হয়েছে বুথস্তরের কর্মীদের। বাস পিছু অন্তত ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। স্থানীয় স্তরের নেতারা সেই বিরাট পরিমাণ টাকা তোলার চেষ্টা করেননি। তার সরাসরি প্রভাব দেখা গিয়েছে জেলায় তৃণমূলের অন্যতম শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত চাপড়ায়।
দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গত বার চাপড়া বিধানসভা এলাকা থেকে ১২২টি বাস গিয়েছিল। এ বার গিয়েছে ৬৭টি। ব্লক সভাপতি জেবের শেখের ব্যাখ্যা, “ক’দিন আগেই আমরা কর্মীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে লোকসভা ভোট করেছি। এ বার ফের এত টাকার চাপ তাঁদের অনেকেই নিতে পারেননি।”
প্রায় একই অবস্থা করিমপুর-২ ব্লকেও। দলীয় সূত্রে জানা যায়, গত বছর নন্দনপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা থেকে ১২টি বাস ছেড়েছিল। এবার ছেড়েছে মোটে পাঁচটি। নতিডাঙা-১ অঞ্চল থেকে গত বছর ন’টি বাস ছেড়েছিল, সেখানে এ বার মাত্র দু’টি। নতিডাঙা-২ অঞ্চল থেকে গত বছর বাস ছেড়েছিল চারটি। সেখানে একটি বাস ছেড়েছে। দিঘলকান্দি থেকে গত বছর ১৯টি বাস ছেড়েছিল। এ বার ছেড়েছে ১৪টি। রহমতপুর থেকে গত বছর ২৩টি বাস ছেড়েছিল, সেখানে ২১টি বাস ছেড়েছে। যদিও ব্লক সভাপতি রাজু মল্লিকের দাবি, “আমার ব্লক থেকে ৭০টি বাস ছেড়েছে।” কিন্তু তাঁর দাবির সঙ্গে যে বাস মালিক সমিতির দেওয়া হিসাব মিলছে না? এর কোনও সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি।
প্রায় একই অবস্থা রানাঘাট থেকে কল্যাণী পর্যন্ত। রানাঘাট বাস মালিক সমিতির সম্পাদক মদন দাস বলছেন, “গত বছর আমাদের থেকে ৩৫টি বাস নেওয়া হয়েছিল। এ বার কিন্তু একটা বাসও যায়নি।” চাকদহের বাস মালিকেরা জানিয়েছেন, গত বছর তাঁদের কাছ থেকে ৪০টি মতো বাস নেওয়া হয়েছিল, এ বার কমে হয়েছে ১০টি। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের একটা অংশের দাবি, এ বার রানাঘাট বা চাকদহ থেকে বাস কম ছাড়লেও ট্রেনে কর্মীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। যদিও তা অন্য বারের তুলনায় কম বলেই মনে করছেন তারা।
তবে নেতারা যা-ই বলুন, কাটমানি নিয়ে রাজ্য জুড়ে তৈরি হওয়া চাপ যে বাস নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে, তারও ইঙ্গিত মিলেছে বিভিন্ন সূত্রে। জেলা পরিষদ ও প্রশাসনের বিভিন্ন দফতর, মহকুমা, ব্লক, পঞ্চায়েত ও পুরসভা অফিস থেকে নানা কাজের বরাত পাওয়া ঠিকাদারেরা শাসক দলের কর্মসূচির জন্য ‘চাঁদা’ দেন। এই রীতি বাম জমানাতেও ছিল। দিতে কাজ করাতে হয়। কে কত টাকা ‘চাঁদা’ দেবেন তা ঠিক হয় তিনি কত টাকার কাজ পাচ্ছেন, তার উপরে।
তৃণমূল সূত্রের খবর, এ বার নেতাদের অনেকেই সেই পথে হাঁটতে চাননি। কিছুদিন যাবৎ কাটমানি নিয়ে হইচই হতে থাকায় টাকা তোলা বা অন্য সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার ব্যাপারে অনেকেই গুটিয়ে রয়েছেন। অনেকেই কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি। নিজের এলাকার কর্মীদের ট্রেনে কলকাতায় যেতে বলে দিয়েছেন তাঁরা। সেই কারণে বাস কম ভাড়া হয়েছে, ট্রেনে বিড় বেশি হয়েছে বলে তাঁদের দাবি। এক নেতার দাবি, ‘‘গত বার একুশে জুলাইয়ের সভার জন্য আমি একাই অন্তত ছ’লক্ষ টাকা খরচ করেছিলাম। এ বার আর সেটা করে ওঠা যায়নি।’’
বিজেপির নদিয়া উত্তর সাংগঠনিক জেলা সভাপতি মহাদেব সরকারের কটাক্ষ, ‘‘তৃণমূল তো তোলাবাজি করেই প্রতি বার ব্রিগেড ভরানোর ব্যবস্থা করে। কাটমানির বাজারে মানুষ সজাগ হয়ে যাওয়ায় এ বার আর ওরা পুকুর চুরি করতে পারেনি। আর, বাস ভাড়া করলেও যেতই বা কে? সকলে তো ওদের ছেড়ে আমাদের দলে চলে আসতেই ব্যস্ত!’’
তৃণমূলের রানাঘাট সাংগঠনিক জেলা সভাপতি শঙ্কর সিংহ অবশ্য দাবি করছেন, “এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে এ বার লোক কম গিয়েছে। বাস কম হওয়ার কারণ, আমরা প্রথমেই বলে দিয়েছিলাম যে বাসে গেলে নানা সমস্যা হয়। তাই যাদের ট্রেনে যাওয়ার সুযোগ আছে তারা যেন ট্রেনেই যান।” তিনি আরও বলেন, “আমাদের এলাকায় এক মাত্র হরিণঘাটায় ট্রেন সংযোগ নেই। সেই কারণে শুধু সেখান থেকেই ৭০টার মত বাস ছেড়েছে।”
নেতারা যা-ই দাবি করুন, এ বার নদিয়ার একুশে-যাত্রা যে অনেকটাই ম্রিয়মাণ হয়ে রইল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy