ব্রাত্য বসু তাঁর সহপাঠী ও বন্ধু।
প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের রাজ্য সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য তাঁর জামাইবাবু।
স্বামী কান্দি টাউন তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি।
কোন খুঁটি ঘরে টিকিট ঘরে এসেছে, তৃণমূলের টিকিট না পাওয়া হতাশের দল তা আঁচ করে উঠতে পারছে না। আঁচ করা শক্তও বটে। খুঁটি যে অনেকগুলো।
ঘরের খুঁটিটাই বরং তুলনায় নড়বড়ে। কিন্তু তা বলে তিনি বড় বন্দরে জাহাজ ভেড়াতে জানেন না, এমনটাও নয়।
তিনি কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়। বহরমপুর কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বামী। গিন্নির ইলেকশন এজেন্টও বটে। চওড়া করে হাসছেন। বলছেন, ‘‘পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য! এ তো ধম্মের কথা!’’
এ সব বাণীতে অবশ্য বহরমপুর তৃণমূলের কোনও পাল, কোনও ত্রিপাঠীর টিকিট না পাওয়া জ্বালা জুড়োচ্ছে না। তবে তা নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথাও নেই কৌশিকের। কান্দির ‘রাজাবাবু’ প্রয়াত অতীশ সিংহের সঙ্গেই কয়েক বছর আগে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন কান্দি রাজ হাইস্কুলের শিক্ষক কৌশিক।
‘‘গত পুরভোটে কান্দির ২ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের প্রার্থী ছিলাম আমি। ভোট যে একেবারে বুঝি না, তা নয়। টিকিট পেতে ব্যর্থ হয়ে বহরমপুর তৃণমূলের যে অংশ সুজাতাকে ‘ভুঁইফোড় তৃণমূল’ আখ্যা দিচ্ছেন, ভোট প্রচার থেকে সরে থাকছেন তাঁদের উদ্দেশ্যে জনান্তিকে বলি, আপনারা কিন্তু ঠিক করছেন না’’— বলছেন কৌশিক।
কিন্তু তাঁর বাণী কানে তুলছে কে? প্রার্থী ঘোষণার পরে খোদ দলের জেলা সভাপতি মান্নান হোসেনই নাকি ঘনিষ্ঠ মহলে (তৃণমূল সূত্রের খবর) প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘কে সুজাতা? এঁকে তো কখনও তৃণমূলের পতাকা তলে দেখিনি!’’ চোরকাঁটা অতএব গোড়াতেই বিঁধেছে।
তার উপর কৌশিকের অতীত-বর্তমান যা-ই হোক, মধ্য চল্লিশের সুজাতা নিজে রাজনীতিতে আনকোরা। বরং খোঁপায় ঘাসফুল গোঁজার আগে অন্য একটা পরিচয়েই বহরমপুর শহর বেশি চিনত তাঁকে। সেটা হল, ১৬৩ বছরের পুরনো কৃষ্ণনাথ কলেজের প্রথম মহিলা অধ্যক্ষ। এর আগে বোলপুর কলেজে ছিলেন, পড়িয়েছেন লালগোলা কলেজেও। কিন্তু ভোটের মাঠ তাঁর অচেনা।
লড়াইটাও তো অসম। অধীর চৌধুরীর গড়ে (পড়ুন, সিংহের গুহায়) গত বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট পেয়েছিল ৫৫ শতাংশ ভোট। গত লোকসভা ভোটে কংগ্রেস এবং বামফ্রন্টের মিলিত ভোট ৭০ শতাংশ। সার্বিক জোট হয়েছে। তার উপরে জোটের তরফে দাঁড়ানো কংগ্রেস প্রার্থীও তো জবরদস্ত!
সেই প্রার্থী, মনোজ চক্রবর্তীও শিক্ষক, তবে অবসরপ্রাপ্ত। শহর থেকে দূরে, বদরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩৯ বছর পড়িয়েছেন তিনি। তবে তাঁর অন্য পরিচয়টাই লোকে বেশি জানে (সুজাতার ঠিক উল্টো)। তিনি টানা দু’ বারের বিধায়ক, এ বার হ্যাট্রিক-প্রত্যাশী।
মজার ব্যাপার, মধ্য-ষাটের মনোজ কিন্তু রাজনীতির অনুশীলন শুরু করছিলেন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুলের ছাত্রজীবন থেকেই। পরে ধাপে ধাপে ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতির পদ সামলে, জেলা কংগ্রেস হয়ে কয়েক বছর হল তিনি প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৮৭ থেকে টানা ১৯৯৮ পর্যন্ত বহরমপুর পুরসভার কাউন্সিলর।
২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে বহরমপুরে তৃণমূল-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী ছিলেন স্থানীয় বিধায়ক, কংগ্রেসের মায়ারানি পাল। তাঁকে অস্বীকার করে তৎকালীন জেলা কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী ‘কুড়ুল’ প্রতীকে নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করান মনোজকে। মায়ারানিকে তৃতীয় স্থানে ঠেলে দিয়ে মনোজ জেতেন ২৬ হাজার ভোটে।
২০১১ সালে কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের প্রার্থী হিসেবেই হাত চিহ্নে লড়েন মনোজ। জেতেন ৪৩ হাজার ভোটে। মন্ত্রীও হন। কিন্তু ছ’মাস বাদেই কংগ্রেস বা তাঁর সঙ্গে কোনও আলোচনা না করেই দফতর বদল করে জোট সরকার। মনোজ শিবিরের দাবি, সেই সময়ে তিনি ফোনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, ‘‘আপনার মধ্যে সৌজন্যবোধ নেই। আপনার মন্ত্রিত্ব ছেঁড়া চপ্পলের মতো ছুড়ে ফেলে দিলাম!’’ আর তিনি মহাকরণ-মুখো হননি। আট মাস বাদে একই পথ ধরে মন্ত্রিত্ব ছাড়েন আবু হেনা, মানস ভুঁইঞা- সহ কংগ্রেসের সব মন্ত্রী। জোটটাই ভেঙে যায়।
ফলে, লড়াইটা প্রায় একপেশে। জেতার ব্যাপারে মনোজ এতটাই নিশ্চিত যে নিজের কেন্দ্রের ভার কর্মীদের উপরে ছেড়ে দিয়ে স্বচ্ছন্দে পাশের জেলায়, নদিয়ার কৃষ্ণনগর বা কৃষ্ণগঞ্জে চলে যাচ্ছেন ভোটের প্রচারে। আর, সুজাতাকে ঘুরতে হচ্ছে দোরে-দোরে। দিতে হচ্ছে কৃষ্ণনাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার এবং ‘সার্বিক উন্নয়ন’-এর আশ্বাস। চায়ের দোকান থেকে কৃষকের উঠোনে গিয়ে হাত জোড় করে উদয়াস্ত বলতে হচ্ছে, ‘‘আমাকে জেতান। মমতাদির হাত ধরে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেব। এক বার সুযোগ দিন।’’
যা শুনে মনোজ হাসছেন, বলছেন— ‘‘পুরো টাকা দিয়েছে রেল, ঠিকাদারও নিয়োগ করেছে। তার পরেও তিন বছর ধরে চুঁয়াপুর ও পঞ্চাননতলায় রেলের উড়ালপুল আর বেলডাঙায় আন্ডারপাস করতে দেয়নি তৃণমূল। সেই তৃণমূলের মুখে এ জেলার উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি শুনে ঘোড়াতেও হাসবে।’’
এর পরেও সুজাতা অবশ্য হাল ছাড়েননি। বরং ‘একটা সুযোগ’ পাওয়ার আশায় যা কিছু করা সম্ভব, করছেন। যেমন, নাগরিক সমাজের মন পেতে শহরের রাজপথে ঘোড়ানাচ, বাউল গান, ঢাক ও রণপা নিয়ে শোভাযাত্রা বের করেছেন। গ্রামীন জনতার মন কাড়তে আবার গত শনিবার শতাব্দী রায়কে নিয়ে এসে পঞ্চায়েত এলাকায় ‘রোড-শো’করেছেন।
জানলার পর্দা ফাঁক করে, বারান্দা থেকে ঝুঁকে পড়ে লোক দেখেছেও। আমোদও পেয়েছে। ভোট আসে, ভোট যায়। হার-জিত তো আছেই। যে-ই জিতুক, ভোটের আগে এই পড়ে পাওয়া মজাগুলোই বা কম কীসে?
আর তো দু’টো দিন বাকি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy