তারাময় দাস।
বাপ্পী লাহিড়ীর বয়স তখন তিন কি চার বছর হবে। বাবা অপরেশ লাহিড়ী নবদ্বীপের সোনার গৌরাঙ্গ বাড়িতে গান গাইতে এসেছিলেন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। সে দিন ১২০ ফরম্যাটের রোল ফ্লিম ক্যামেরায় ছোট্ট বাপ্পীর ছবি তুলেছিলেন এক আলোকচিত্রী।
বছর চল্লিশ পরে নবদ্বীপ রেলওয়ে রিক্রিয়েশন ক্লাবের মাঠে অনুষ্ঠান করতে এসেছেন বাপ্পী। সেখানেও হাজির সেই আলোকচিত্রী, হাতে সাদা-কালো প্রিন্ট করা ছোট্ট ছেলেটার সেই ছবি। ছবি দেখে বাপ্পী তো আপ্লুত!
তিনি তারাময় দাস। সারা নবদ্বীপ যাকে ‘তারাদা’ বা ‘টি দাস’ নামেই চেনে। ছোটবেলা কেটেছে শান্তিপুরে, সেখান থেকেই ম্যাট্রিক পাশ। তার পর চলে আসেন নবদ্বীপে। পোড়ামাতলায় সেই সময়ে তাঁর দাদার ‘রূপলেখা’ নামে একটা স্টুডিয়ো ছিল, সেখানেই ফটোগ্রাফিতে হাতেখড়ি তারাময়ের। কিছু দিন কাজ শিখে কলকাতায় যান আরও ভাল করে ফটোগ্রাফির কাজ শেখার জন্য।
তারাময় দাসের ক্যামেরায় তোলা জওহরলাল নেহরুর ছবি।
তারাময়ের ছোট ছেলে তপন দাসের কাছে জানা গেল, কলকাতায় ইউনিভার্সাল আর্ট গ্যালারি স্টুডিয়োয় কাজ শিখে কিছু দিন সেখানেই কাদের খান নামে এক ব্যক্তির স্টুডিয়োয় কাজ করেন তারাময়। শেষে নবদ্বীপে ফিরে এসে ১৯৫৩ সালে পোড়ামাতলায় নকুলেশ্বর রায়ের বাড়ি ভাড়া নিয়ে ‘টি দাস ইলেকট্রো স্টুডিয়ো’ খোলেন। কিছু দিন পরে সেই দোকানঘর ছেড়ে দিয়ে রাস্তার উল্টো দিকে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে স্টুডিয়ো সেখানে সরিয়ে নিয়ে যান। পরে নকুলেশ্বর রায় তাঁর বাড়িটা তারাময়কে বিক্রি করে দিলে পুরনো বাড়িতে স্টুডিয়ো ফিরে আসে।
সেই স্টুডিয়ো আজও চলছে। উল্টো দিকের স্টুডিয়োটাও আছে। সেখানে তাঁর বড় ছেলে বসেন। আর তিনি বসতেন পুরনো স্টুডিয়োতেই। তারাময়ের মৃত্যুর পরে এখন পুরনো স্টুডিয়ো চালান তাঁর ছোট ছেলে। বর্তমানে নবদ্বীপে প্রায় ১২টি স্টুডিয়ো আছে, তবে সকলে একবাক্যে স্বীকার করেন যে চালু স্টুডিয়ো হিসাবে টি দাসের স্টুডিয়োই সবচেয়ে পুরোনো।
সরল মনের সাদাসিধে স্বভাবের এই আলোকচিত্রী সবার ভীষণ প্রিয় ছিলেন। সবার সঙ্গে গল্প করতে ভীষণ ভালবাসতেন তারাময়। আপনভোলা সহজ-সরল স্বভাবের জন্য তাঁর নামে জনশ্রুতিই চালু ছিল যে, মনের ভুলে টি দাস নাকি ছবি তোলার সময় মরাকেও হাসতে বলেন!
সরকারি, বেসরকারি, সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবি তোলা ছাড়াও নানা সময়ে রাজনৈতিক নেতানেত্রীও বন্দি হয়েছেন তারাময়ের ক্যামেরায়। ইন্দিরা গাঁধী যখন কৃষ্ণনগরে আর নবদ্বীপে এসেছিলেন, তিনি ইন্দিরার ছবি তুলেছিলেন। বন্যা পরিদর্শনে কাটোয়ার বল্লভপাড়ায় জওহরলাল নেহরু এলেন, তারাময় সেখানে গিয়ে তাঁর ছবি তুললেন। সেই ছবির প্রিন্ট আজও আছে টি দাসের স্টুডিয়োয়। আনন্দবাজার, যুগান্তরের মতো নানা সংবাদপত্রেও ফ্রিলান্স ফটোগ্রাফারের কাজ করেছেন তিনি।
শেষের দিকে ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তুললেও তারাময়ের মন সেই ফিল্ম ক্যামেরাতেই পড়ে থাকত বলে জানালেন তাঁর ছোট ছেলে তপন দাস। তপন বলেন, ‘‘বাবা প্রায়ই বলতেন, ডার্করুমে নেগেটিভ বা প্লেটে রিটাচ করে প্রিন্ট করার যে আনন্দ, তা ডিজিটালে কোথায়?’’
তারাদার হাতে শেষ ছবি উঠেছিল ২০০৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর। তার পরের দিন সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যান হাসিখুশি তারাদা।
দিনটা ছিল বড়দিন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy