Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
পাচারের পাঁচকাহন-৫

সীমান্তের সিন্ডিকেট

পাচার নিষিদ্ধ। ওঁরা জানেন। কিন্তু মানতে চান না। উল্টে দাবি করেন, এ তো ব্যবসা। সেই ‘ব্যবসা’য় লাভ আছে। জীবনের ঝুঁকি আছে আরও বেশি। তবুও সীমান্তে চোরাচালান বন্ধ হয়নি। বরং বদলেছে তার কৌশল। বদলেছে পাচার সামগ্রী।নিউটাউন-সল্টলেকে তাদের অনুমোদন ছাড়া ইট পড়ে না।এ বার, সে ছায়া পড়েছে সীমান্তের পদ্মাপাড়েও। তবে ইট-বালি-সুড়কি নয়। তাদের অঙ্গুলি হেলনেই রাতের আঁধারে পাচার হচ্ছে শ’য়ে শ’য়ে গরু।

গায়ে নম্বর। দল বেঁধে চলছে সীমান্তের দিকে। — ফাইল চিত্র

গায়ে নম্বর। দল বেঁধে চলছে সীমান্তের দিকে। — ফাইল চিত্র

বিমান হাজরা ও সুস্মিত হালদার
শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৬ ০০:৩৬
Share: Save:

নিউটাউন-সল্টলেকে তাদের অনুমোদন ছাড়া ইট পড়ে না।

এ বার, সে ছায়া পড়েছে সীমান্তের পদ্মাপাড়েও। তবে ইট-বালি-সুড়কি নয়। তাদের অঙ্গুলি হেলনেই রাতের আঁধারে পাচার হচ্ছে শ’য়ে শ’য়ে গরু।

সুতির বিশ্বাসপাড়া। বাগানে বাঁধা রয়েছে গরু। বাইরের লোকের দেখলে মনে হতেই পারে, বাড়িরই পোষা গরু বাগানে আটকানো।

না, তা কিন্তু নয়। আসলে রাতের অন্ধকারের অপেক্ষা। স্থানীয় এক গ্রামবাসীই বললেন, ‘‘ও গরু পোষা নয় গো। রাতে ও পার থেকে ‘বাগাল’ এসে ওকে খুলে নিয়ে যাবে।’’

পুলিশ জানাচ্ছে, ফরাক্কা থেকে জলঙ্গি, জনা চল্লিশ যুবকের তত্ত্বাবধানে এ ভাবেই চলছে দু’টি পাচার সিন্ডিকেট। চোখের ইশারাতেই চলছে পদ্মা-পারাপার। রাতে পদ্মা পেরিয়ে আসছে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা। রাতভর সুতির মুন্নাপাড়া, ঝাঙনিপাড়া, খরিবোনা, ফতেপুর, গোঠাপাড়া, খেজুরতলা, বোলতলা— ঘাট পেরিয়ে হাজারো গরু হারিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জের বিভিন্ন গাঁ-গঞ্জে।

একই অবস্থা নদিয়ার। পাচারকারীদের দখলে দীর্ঘ তালিকা। নদিয়ার হোগলবেড়িয়া, কাছারিপাড়া, করিমপুর, শিকারপুর, পাকশা, রাউতবাড়ি, পণ্ডিতপুর, বেতাইয়ের লালবাজার, সূঁটিয়া, বেতবেড়িয়া, ব্রক্ষ্মনগর, ডোমপুকুর, হাটখোলা, মহখোলা, গোংড়া, শিমুলিয়া, কাদাঘাটা, গেদে, বানপুর, উমরপুর, বড় চুপড়িয়া, উলাশী, রামনগর, কুলগাছি, বরনবেড়িয়া-সহ বেশ কিছু এলাকা সিন্ডিকেটের দখলে। জানাচ্ছে জেলা পুলিশেরই একাংশ।

পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে বললেন সুতি ১ ব্লকের এক পঞ্চায়েত প্রধান। বললেন, “লরিতে করে আসা গরু এসে ভিড় করে আহিরণের ১২০ নম্বর ঘাট ও সিআরপি ঘাটে। সেখান থেকে সোনারপাড়া হয়ে গিরিয়া দিয়ে সোজা পদ্মার চর পেরিয়ে সীমান্তে।” স্থানীয় রাখাল নয়, সরাসরি বাংলাদেশ থেকেই বাগাল আসছে গরু নিয়ে যেতে। রাত্রি নামতেই কাতারে কাতারে গরু সুতির পাঁচটি নির্দিষ্ট ঘাট দিয়ে চলেছে পদ্মার দিকে। চাঁদের মোড় ধরে নুরপুর ঘাটের কাছে গরু নিয়ে পদ্মায় নেমে পড়ছে পাচারকারীরা।

যে ভাবে অপারেশন

জেলা পরিষদের এক সদস্যই বাতলিয়ে দিচ্ছেন সিন্ডিকেটের কাজের পদ্ধতিটা— ‘‘পদ্মা লাগোয়া গ্রামগুলোতে বাংলাদেশিরা দিনের বেলায় এসে ঢুকে পড়ে। তার পর বিশ্রাম নিয়ে রাতে তারাই নিয়ে যায় গরুর পাল। সিন্ডিকেটের হাতে আসছে মোটা টাকা।’’ তবে পদ্মা লাগোয়া ওই গ্রামগুলিতে গরু পৌঁছে দেওয়াটুকুই শুধু সিন্ডিকেটের কাজ। বাকি দায় বাংলাদেশিদের। কেমন? সিন্ডিকেটের কাজ গ্রামে আসা গরুগুলোর দেখভাল করা, পাহারা দেওয়া আর গ্রামে আসা বাংলাদেশিদের লুকিয়ে রাখা। স্থানীয় পুলিশ ও বিএসএফের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ।

দল বেঁধে

সিন্ডিকেট অর্থে গোষ্ঠী। এক-একটি গোষ্ঠীতে এলাকার ২০ থেকে ২৫ জন রয়েছে। যারাই গরু পাচার করে পয়সা রোজগারের পথে যাবে, এই সিন্ডিকেটে তাদের নাম লেখাতে হবে। বছর খানেক আগেও এলাকার তরুণদের টাকার লোভ দেখিয়ে গরু নিয়ে যাওয়ার রাখালের কাজ করানো হত। কিন্তু এখন সে কাজ করে বাংলাদেশ থেকে আসা একদল যুবক। এক তৃণমূল নেতা বলছেন, “সাদিকপুর ও বাজিতপুর পঞ্চায়েতের গ্রামগুলিতে এখন চলছে গরু পাচার। একটি সিন্ডিকেট চালাচ্ছে নাসির ও আনারুল। অন্যটিতে আছে হাবিল, বাজারুল, মোতাবুলরা।”

মাঝে মধ্যে অবশ্য এই সব নাম বদলে যায় ‘প্যাড’ (পাচার ব্যবসার ছাড়পত্র) বদলের সঙ্গে। সিজন বুঝে প্যাডের দাম নিলামে বাড়ে বা কমে। প্যাডের মাথায় শাসক দলের একাধিক ছোট, বড় নেতা, বিধায়কের নাম হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় জেলাজুড়ে।

এক-এক দিনে ১০ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা নিট আয় পকেটে ঢুকছে সিন্ডিকেটের মাথাদের। সিন্ডিকেটে যুক্ত এক-এক জন তরুণের দৈনিক আয় কম করে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। তবে এ কথা উঠতেই এদের এক জন ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন, “আমাদের আয়টাই দেখছেন। এর থেকে ৩০ শতাংশ যায় পুলিশ আর বিএসএফ সামলাতে।”

কী রকম? দশ টাকার একটা ‘নোট’ বদলে দেয় সীমান্তের পথ। তারিখ সহ দু’টো শব্দ লেখা ওই নোট উর্দিধারীদের হাতে গুজে দিতে পারলে কেল্লাফতে। বিশেষ সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলা পুলিশের একাংশের তরফ থেকে আগাম মোটা টাকা নিয়ে ইস্যু করা হচ্ছে ওই নোট। দশ টাকার ওই নোটের দাম ৫ থেকে ৭ হাজার। ছোট ৪টে গরুর জন্য ৫ হাজার আর বড় চারটের জন্য ৭ হাজার টাকার কড়কড়ে নোট দিয়ে তবে সিণ্ডিকেটের কাছ থেকে মিলবে ওই নোট।

মানুষের ভোগান্তি

সুতিরই গ্রাম ইসলামপুরের মুন্সিপাড়া। স্থানীয় মানুষের দাবি, গরু পাচারের এখন প্রধান ঘাঁটি এটাই। এখানেই নিজেদের এজমালি বাড়িতে থাকেন তিন ভাই, যাদের দু’ভাই-ই গরু পাচারের হোতা। দিনের বেলায় তাদের বাড়ির মধ্যেই রাখা হচ্ছে গরুর পাল। অনেক সময়ে গরু বেশি এসে পড়লে, অন্যদের বাড়িতে রাখার জন্য চাপ দেওয়া হয়। ‘না’ বলার সাহস নেই কারও। একবার এক জন বেঁকে বসেন। পরের দিনই সিন্ডিকেটের লোকজন চড়াও হয় তাঁর উপর।

আর প্রশাসন

সিন্ডিকেটের সঙ্গে যে স্থানীয় তৃণমূলের যোগসাজশ রয়েছে, অকপটে তা মেনে নিচ্ছেন সিন্ডিকেটের হোতারাই। তাদেরই এক জন বলছেন, ‘‘শাসক দলের মদত ছাড়া কাজ করা যায়? হিস্সা পেয়ে গেলে সবাই চুপ করে যায় দাদা!’’ তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের একাংশ মেনে নিচ্ছেন এ কথা। রঘুনাথগঞ্জ ২ ব্লকের গিরিয়ার প্রাক্তন প্রধান ও তৃণমূল সংখ্যালঘু সেলের সভাপতি রুস্তুম আলি বলছেন, “তৃণমূলের বেশ কয়েক জন নেতা এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে পরোক্ষে জড়িত।’’ জেলা সভাপতি মান্নান হোসেনের বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন গরু পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। এখন দলের কেউ যদি জড়িত থাকে, তা হলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Syndicate
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy