সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। বহরমপুর শহরে লালদিঘির পাড়ে একটা ভাড়াবাড়ির বারান্দায় খয়াটে চেহারার লোকজনের উপচে পড়া ভিড়। ঘড়ির কাঁটা তখন সবে সকাল ৯টার ঘর ছুঁয়েছে। ঘরের ভিতর থেকে এক জন সহকারী এসে বিনীত ভাবে বললেন, ‘‘ডাক্তারবাবু এখন এখানে আর এক জন রোগীও দেখবেন না। সময় হয়ে গিয়েছে, তাই তিনি এখন হাসপাতাল রওনা দেবেন। আপনাদের সবাইকে হাসপাতালে যেতে বললেন। সেখানে গেলেই আপনাদের দেখে দেবেন।’’
সবাই থ! এ কেমন ‘ডাক্তারবাবু’? হাসপাতালে থেকে নিজের ‘চেম্বার’, বা নার্সিংহোমে রোগী টেনে নিয়ে যাওয়াটাই তো দস্তুর। সেখানে এই ডাক্তার নিজের চেম্বার থেকে রোগী ঠেলছেন হাসপাতালে!
সহকারী ভদ্রলোক জানালেন, প্রাইভেট চেম্বারে তাঁকে দেখাতে হলে সেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে। দূর দূরান্তের বাড়িতে ফিরতে রাত হয়ে যেতে পারে রোগীদের। তাই চেম্বারের রোগীদের হাসপাতালেই দেখে নিতে চান তিনি। প্রেসক্রিপশনের মাথায় অনেকগুলো ডিগ্রির পাশে লেখা থাকত— ‘ডি সেন’,
দেবব্রত সেন।
ভুল হল। বহরমপুর শহর ও শহর ছাড়িয়ে মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন প্রান্তের রিকশাচালক, ঘোড়া গাড়ির চালক, রাস্তার পাশের সরকারি জমি জবরদখল করে গড়ে তোলা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বুকের ভাষায় তিনি ছিলেন ‘দেবতা সেন’।
সে কথা মানছেন বহরমপুর শহরের জেএন অ্যাকাডেমির অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, ৭৪ বছরের নির্মল সরকারও। দেবতা সেন-এর কাছে চিকিৎসা করাতেন তিনি। রাজনৈতিক কারণে ১৯৭৪ সাল নাগাদ জেলবন্দি ছিলেন তিনি। জেলের স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় নির্মলের তখন তীব্র শ্বাসকষ্ট। নির্মল বলেন, ‘‘তাঁর হাত-যশে কেবল আমার মতো লক্ষ লোকের রোগই সারেনি, গরিব মানুষের
মতো অনেক মধ্যবিত্তের কাছেও সদয় ব্যবহারের কারণে তিনি দেবতা সেন হয়ে উঠেছিলেন। নিজেই হয়ে উঠেছিলেন জীবন্ত আরোগ্য নিকেতন।’’
দেবব্রত সেনের বাবা ছিলেন প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক। সেই সূত্রে নামমাত্র বেতনের শিক্ষক নির্মল সরকারের কাছ থেকেও তিনি কখনও ‘ফিজ’ নেননি। তিনি বলেন, ‘‘মুটে-মজুর, রিকশাচালক বুঝলে ফিজ তো নিতেনই না, উল্টে ওষুধ ও বাড়ি যাতায়াতের খরচও হাতে গুঁজে দিতেন।’’
বহরমপুর শহরে এ ঘটনা ‘মিথ’ হয়ে আছে। শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকা ফরাক্কার এক প্রৌঢ়ের বুকে স্টেথো রাখার বদলে দেবব্রতবাবু প্রথমেই কড়াপড়া হাতের তালু দু’টি নেড়েচেড়ে দেখেন। বলেন, ‘‘রিকশা চালান?’’ হ্যাঁ শুনে দেবব্রতবাবু তাঁকে পরীক্ষা করে বলেন, ‘‘ফিজ-টিজ রাখুন। আর যা ওষুধ তা আমিই দিয়ে দেব।’’ সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন এসএসকেএমের ‘বক্ষ’ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান দেবতা সেন। তাঁর স্তব্ধ চেম্বারের সামনে দিয়ে গেলে এখনও গতি কমিয়ে দেন ওই রিকশাচালক। অন্তরীক্ষে হারিয়ে যাওয়া তাঁর দেবতার দিকে এক বার নিশ্চুপে গড় করেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy