Advertisement
১০ জানুয়ারি ২০২৫
Durga Puja 2022

বিসর্জনের একান্তে আর এক বোধন

সেখানে পথের ধারে কয়েকটি খাবার আর মণিহারি দোকান। যেমন থাকে সব পর্যটনকেন্দ্রে। একটি দোকানে ঢুকে দেখি, লম্বা-চওড়া দুই মহিলা। পরনে চুবা। তিব্বতিদের পোশাক।

দেবাশিস চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২২ ০৯:১৬
Share: Save:

প্রিয় রণো,

আজ তোর কথা খুব মনে পড়ছে।

আজ, এই রিমঝিম বৃষ্টি শেষ হওয়া শরতের রাতে এই নির্লিপ্ত কলকাতা শহরেও যে ঘোর হয়ে আকাশ নেমে আসে নির্জন পিচের পথের পাশে, ভেজা ঘাসকে টুক করে ছুঁয়ে যায়, কালো রাস্তার উপরে নির্জনে পড়ে থেকে যে শিউলি বাতাসকে রঙিন করে, সেই রাতে, সেই অপার্থিব শারদ রাতে আবার তোর কথা মনে পড়ছে। খুব মনে পড়ছে।

অথচ এমন অপার্থিব শরতের রাত তো বহু বার দেখেছি আমরা, যখন মণ্ডপে আড্ডার শেষে আমাদের চা খাওয়ার ইচ্ছে হত। রাত হয়তো তখন একটু পরেই ফুরিয়ে যাবে। বাচ্চারা তখনও গোল হয়ে বসে। গিটারের ঝংকারে, কাহনের তালে না থেমে তারা গেয়ে চলেছে পরের পর গান। এক গান থেকে অবলীলায় চলে যাচ্ছে আর এক গানে। সেই সময়ে কে যেন বলে উঠল, এবার এক রাউন্ড চা চাই।

ব্যস, আমরা সবাই মিলে চললাম চায়ের দোকানে। বাচ্চা বলছি যাদের, তারাও এখন বাইশ কি চব্বিশ। তা হলে কি আমরা বুড়ো হতে শুরু করেছিলাম তখনই?

পুজো চলে গিয়েছে, আবার ফিরে এসেছে। এলিয়টের মতো আমার মনে হয়েছে: আশ্বিনই নিষ্ঠুরতম মাস।

কেন বল তো গাল পাড়ব না মাসটাকে? আমি তো তোর মতো পুজোয় মাখামাখি হতে পারিনি কোনও দিন। আমি তো আড্ডার মজাটুকু শুষে নিয়ে চার দিন কাটাতে চেয়েছি। তবু সব সময় মহালয়া থেকে কেন মন খারাপের দিস্তা জমে আসে চারদিকে? বন্ধুদের সঙ্গে কথার পিঠে কথা কাটে। তর্ক হয়। সেই তর্ক ভুল দিকে চলে যায়। বুঝেও আটকাতে পারি না।

আশ্বিন তাই ‘ক্রুয়েলেস্ট’ মাস।

এই মাসে দিন মরে আসে দ্রুত। সড়কের ধারে পাকা ধানের গন্ধ ম ম করে। আলো ফুরিয়ে এলে নিকশ অন্ধকারে কাকতাড়ুয়ার কাঠামো জেগে থাকে প্রেতের মতো।

এই সব পথ দিয়ে তুই, আমি বা আমরা ক’জনে মিলে সেই যে এসেছি, আর ফিরে যাইনি কখনও। যাওয়া কি যায়, রণো? আমাদের গতি তো একমুখী। আমরা শুধু এক দিকে এগিয়ে যেতে জানি।

কিছু দিন পরে কার্তিক-অঘ্রাণ। নতুন ধানে হবে নবান্ন। তুই নতুন চাল হাতের মুঠোয় নিয়ে একবার বলেছিলি, ‘‘দেখ, নিজেদের জীবনকে ধরেছি যেন।’’ মুঠো খুলতেই সেই জুঁই ফুলের মতো ধবধবে চাল তোর হাত জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। সে দিকে তাকিয়ে তুই, আনমনা, বলেছিলি, ‘‘এমন ধানের গন্ধে আমরা অঘ্রাণ মাসকে আহ্বান করতাম, জানিস।’’

বাতাসে কি তখন শিসের মতো শব্দ তুলে কিছু ছুটে এলো? হাতের ধান কি ছিটকে ছড়িয়ে পড়ল আঙিনায়? তার পর কালচে লাল ধারা কি এসে মিশে গেল সেই চালে?

এমনই ধারা স্রোত কোথায় যে কখন মুখ লুকিয়ে থাকে! না হলে তুই বাঙাল বাড়ির ছেলে, তোর কথার সঙ্গে, তার মধ্যে রয়ে যাওয়া সুর-তালের সঙ্গে কী ভাবে মিলে যেতে পারে পাহাড়ের এক উপত্যকায় মা-মেয়ের কথা!

যাওয়া আর আসার এই সড়কে সে বারে পৌঁছে গিয়েছিলাম উপত্যকাটিতে। মাটি তো নয়, পাথর। তার রং আবার মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়েছে। মেটে। আবার তাকে ঢেকে শ্যাওলা জমেছে। দুই রঙের পাহাড়ের মাথায় বেলায় বেলায় বরফ জমেছে। উল্টো দিকে আরও অনেক নীচে নেমে বয়ে গিয়েছে এক পাহাড়ি খরস্রোতা।

সেখানে পথের ধারে কয়েকটি খাবার আর মণিহারি দোকান। যেমন থাকে সব পর্যটনকেন্দ্রে। একটি দোকানে ঢুকে দেখি, লম্বা-চওড়া দুই মহিলা। পরনে চুবা। তিব্বতিদের পোশাক। তিন ঝিকের উনুনটিতে কেটলি আর অন্য পাত্র বসিয়ে এক দিকে তৈরি করে দিচ্ছেন মোমো এবং ম্যাগি, সঙ্গে এগিয়ে দিচ্ছেন চা-ও। তাঁরা মা ও মেয়ে। না, তাঁদের নিজেদের কথা কিছুই বোঝার জো নেই। তবে এক পরিবারের একটি ছোট মেয়ের সঙ্গে কথায় কথায় পরিচয় দিয়ে ফেললেন তাঁরা।

তখনই তাঁদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, কোথায় থাকেন? চুপ করে গেলেন দুই মহিলা। সামান্য থেমে বড় জন জবাব দিয়েছিলেন, এখানেই। এখানকারই মানুষ।

তার পরে, যেন হঠাৎ মনে পড়ে গেল, এই ভাবে জানতে চাই: আচ্ছা, এখান থেকে তিব্বত তো বেশি দূরে নয়। কোন দিকে যেন?

মেয়ে উৎসাহিত হয়ে আঙুল তুলে দেখালেন— ওই দিকে।

মা ওঁকে থামিয়ে বলেন, ‘‘জানি না বাবু। হয়তো ওই পাহাড়ের পিছনে।’’

তোর মতো কি বলছিলেন ওঁরা, রণো— আমার দেশ আছে, কোথায়, ঠিক জানি না। হয়তো যে দেশ ছেড়ে চলে এসেছিলেন আমার বাড়ির মানুষ, সেটাই। হয়তো যেখানে আমি জন্মেছি, বড় হয়েছি, সেটাই।

এই পাহাড় ডিঙোতে কে চায়, বল! সেই তিব্বতি জোব্বায় দুই মহিলা, চায়ের পেয়ালা-পিরিচ এগিয়ে দিতে দিতে নিজেদের মধ্যে তাঁরাই বা কী বলছিলেন?

ভাষা না জানলেও তাঁদের কথার সুর যেন চুর চুর হয়ে গড়িয়ে পড়ে তোর কথাগুলির শরীর বেয়ে।

আজ, বিশেষ করে আজকের রাতে যখন ঘোর লাগা আকাশ এসে মাটিতে ঠেকেছে এবং শহরের কেউ তা দেখছে না, কারও ফুরসত নেই, কারও যেন ইচ্ছে নেই, কারও মনে কাঁটাতার নেই, সকলেই অপেক্ষায় আছে কাল, বোধনের।

এর মধ্যে রণো, তুই, সকলের কাছে অজানা অচেনা একটি ছেলে, সেই তিব্বতি মা-বেটির মতো নিজের মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এক জন মানুষ, কোথায় হারিয়ে গেলি, এখনও আমার কাছে অপার বিস্ময়। তোকে আর গল্প শোনানো হবে না। তোর সঙ্গে দুষ্টুমি করতে করতে বুড়ো হব না। তোর কথায় সায় দিয়ে দু’জনেই খুঁজতে যাব না পূর্বপুরুষের ভিটে।

এই কলকাতা শহরে, স্বার্থপর, নির্লিপ্ত শহরে, নিয়নের মতো অর্থহীন উজ্জ্বল শহরে তোকে আর দেখতে পেলাম না আয়নার সামনে। বারবার এসে, ঘুরে গিয়েও।

আজই তো তোকে দরকার ছিল, রণো। বোধনের আগের রাতে। কিন্তু তোর সেই আপাপবিদ্ধ সত্ত্বা এই শহরে হারিয়ে গেল।

এও কি আর এক বোধন? নির্লিপ্ততার?

ইতি...

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja 2022
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy