ক্ষতি: ডুবেছে চাষের জমি। নষ্ট ফসল। ফাইল চিত্র
কার্তিকের শেষ। শীত আসি আসি করেও থমকে। দুপুরের মিঠেকড়া রোদে পিঠ পেতে ছাগলকে কাঁঠাল পাতা খাওয়াচ্ছিল অষ্টমী। পিছন থেকে মার গলা জড়িয়ে দোল খাচ্ছে তার বছর সাতের ছেলে। আধো আধো গলায় প্রশ্নে প্রশ্নে মাকে সে জেরবার করে দিচ্ছিল। —‘মা কাত্তিক পুজো কবে?’ অষ্টমী কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে পল্টু জিজ্ঞেস করে— ‘মা কাত্তিক ঠাকুর কি ময়ূরের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়ায়?’ ‘হ্যাঁ বাবা, ময়ূর হল কাত্তিক ঠাকুরের বাহন।’’ ‘মা বাহন কী!’’ ছাগলকে পাতা খাওয়াতে খাওয়াতেই ছেলের একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলেছিল অষ্টমী। ‘মা এ বার আমরা কাত্তিকের লড়াই দেখতে যাব না’! ছেলের এই প্রশ্নে চুপ করে যায় অষ্টমী। অধৈর্য শিশুমন ফের শুধোয়, ‘বল না, যাব না!’’ ছেলে বিরক্ত করায় অষ্টমী থেমে থেমে বলে, ‘‘না বাবু, তোর বাবার শরীরটা তো ভাল নেই। এ বার যাব না। বিকেলে বরং তোকে ও পাড়ায় নিয়ে যাব। দেখবি, সেখানে কারখানায় কত বড় বড় কাত্তিক ঠাকুর তৈরি হচ্ছে।’’ একরত্তি ছেলেকে আশাহত হতে দেখে বড্ড কষ্ট হচ্ছিল অষ্টমীর। আঁচলের খুঁটে চোখের জল মোছে সে।
বেলডাঙা ব্লকের মহুলা গ্রামে বাড়ি অষ্টমীদের। স্বামী-ছেলে নিয়ে সংসার। তার স্বামী লক্ষ্ণণ পেশায় লঙ্কাচাষি। নিজেদের জমি নেই। অন্যের জমি ইজারা নিয়ে চাষ করে লক্ষ্মণ। এ বারও মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে এক বিঘে জমিতে লঙ্কাচাষ করেছিল সে। আশা ছিল, ঘরে লঙ্কা তুলে দুটো পয়সার মুখ দেখবে। কিন্তু বিধি বাম! ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আর অকালবৃষ্টি তার সব আশায় জল ঢেলে দিয়েছে। দু’দিন আগে মাঠে গিয়ে চোখে জল এসে গিয়েছিল লক্ষ্মণের। খেতে একের পর এক লুটিয়ে পড়েছে ফলন্ত লঙ্কাগাছ। ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির সঙ্গে যুঝে কোনওরকমে দাঁড়িয়ে রয়েছে যে গাছগুলো, সেগুলোরও ফুল সব ঝরে গিয়েছে।
সে দিন দুপুরে খেতে বসে কোনও কথা বলছিল না লক্ষ্মণ। সামনে ভাতের থালা আলগা পড়ে। একমনে আকাশপাতাল ভেবে চলেছে সে। স্বামীকে আশ্বস্ত করতে অষ্টমী বলে ওঠে, ‘‘মোটে তো তিনটে পেট। অত চিন্তা করছ কেন! ঠাকুর সব ঠিক করে দেবে।’’ বৌয়ের কথা লক্ষ্ণণের কানে পৌঁছয় না। মহাজনের টাকা শোধ করবে কী করে, সেই চিন্তায় ব্যাকুল সে। একসময় বৌয়ের কাঁধে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে সে।
‘আমার সব শেষ হয়ে গেল রে অষ্ট।’ গত দু’দিন একবারের জন্যও মাঠে যায়নি লক্ষ্মণ। ঘর থেকে বেরনোও বন্ধ করে দিয়েছে। খেতের লঙ্কা খেতেই পড়ে পড়ে পচছে।
ছাগলকে খাওয়ানো শেষ হলে ঘরের ভেতর ঢোকে অষ্টমী। অন্ধকার ঘরে তক্তপোশে শুয়ে চালার বাতার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে লক্ষ্ণণ। শূন্য সে দৃষ্টি। অষ্টমী কিছু বলে না।
বাঁশের গায়ে পেরেকে আটকানো আয়নাটায় নিশ্চুপে মুখটা একবার দেখে নেয়। চুলটা ঠিক করে চিরুনির ডগা দিয়ে সিঁথিতে সিঁদুর পরে। তারপর দোর টেনে ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। গ্রামের পাশ দিয়ে মেঠো পথ। সোজা চলে গিয়েছে মহুলার পাশের পাড়ায়। সেই পথে মিলিয়ে যায় মা-ছেলে। মেঠো রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় লঙ্কা খেতটার দিকে একবার চোখ পড়েছিল অষ্টমীর। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারেনি। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল তার।
ও পাড়ায় ঠাকুর তৈরির কারখানায় দু’জন যখন পৌঁছল, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। প্রতিমার রঙ সারা। গায়ে শোলার গয়না পরাচ্ছিল কমবয়সী একটা ছেলে। পাশে দাঁড়িয়ে হাঁ করে তার কাজ করা দেখছিল পল্টু। এই ভাবেই কেটে গেল বহুক্ষণ। ফিরে আসার সময় পল্টুর হাতে একটা শোলার মুকুট তুলে দিল সেই ছেলেটা। সেটা পেয়ে আনন্দ আর ধরে না তার। সারাটা রাস্তা মুকুটটা একবারের জন্যও কাছছাড়া করল না পল্টু। কতক্ষণ বাবাকে সেটা দেখাবে, সেটা ভেবেই আনন্দে টগবগ করে ফুটছিল সে। বাড়ির কাছে এসে ছেলেকে অষ্টমী শুধোয়, ‘‘হ্যাঁরে, ঠাকুরকে জোড়হাত করে তখন কী বলছিলি রে!’’ শোলার মুকুটটা হাতের চেটোয় সামলে নিয়ে পল্টু বলে, ‘বললাম, ঠাকুর, আমার বাবাকে ভাল করে দিও।’’
দূর থেকে শাঁখের শব্দ ভেসে আসছিল। ঘোমটাটা আলগোছে টেনে নেয় অষ্টমী। তারপর হাতদুটো জড়ো করে আকাশের দিকে চেয়ে বলে, ‘‘ঠাকুর, একরত্তি ছেলেটার কথাটা একটু শুনো!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy