Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

কোন পথে মাদ্রাসা শিক্ষা

ধর্মীয় পরিচিতিকে সচেতনভাবে টিকিয়ে রাখার পন্থা হিসেবে অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে কৌমি বা খারিজি (সম্প্রদায়ের নিজের উদ্যোগে তৈরি) মাদ্রাসা তৈরি হয়। এই সমস্ত মাদ্রাসাগুলি মুক্ত। সরকারের কোনও রকম নিয়ন্ত্রণ এই মাদ্রাসাগুলির উপর নেই।

মনিরুল শেখ
শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৭ ০২:১৯
Share: Save:

ধর্মীয় পরিচিতিকে সচেতনভাবে টিকিয়ে রাখার পন্থা হিসেবে অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে কৌমি বা খারিজি (সম্প্রদায়ের নিজের উদ্যোগে তৈরি) মাদ্রাসা তৈরি হয়। এই সমস্ত মাদ্রাসাগুলি মুক্ত। সরকারের কোনও রকম নিয়ন্ত্রণ এই মাদ্রাসাগুলির উপর নেই।

খারিজি মাদ্রাসা তৈরির প্রেক্ষাপটটা কী? শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের পরাজয়ের পরে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। দেশের শাসনভার গ্রহন করে ব্রিটিশ। সেই সময় রাষ্ট্র শাসনের ক্ষেত্রে ইসলামের প্রভাব লোপ পায়। রাষ্ট্র অনেকটা আজকের দিনের ধর্ম নিরপেক্ষতার মোড়কে থাকতে শুরু করে। এমন অবস্থায় নিজেদের সংস্কৃতি, কৃষ্টিকে সচেতন ভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলিমরা নিজেদের উদ্যোগে মাদ্রাসা গড়ে তুলতে থাকে। তখনকার মাদ্রাসাগুলি অবশ্য সে ভাবে সংগঠিত ছিল না। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন সময়ের খারিজি মাদ্রাসার প্রকৃতি ছিল ঢিলেঢালা। মূলত মসজিদ সংলগ্ন জায়গায় মোক্তব তৈরি করে দেওয়া হত ধর্মের প্রাথমিক পাঠ। ধর্মগ্রন্থ পড়তে শিখে গেলেও পড়ুয়াদের মোক্তব থেকে ছেড়ে দেওয়া হত।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে পশ্চিমবঙ্গে খারিজি মাদ্রাসা একটা আন্দোলনের আকার নেয়। যদিও অনেক আগে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিং ক‌লকাতা মাদ্রাসা (অধুনা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়) তৈরি করেন। কিন্তু ওই মাদ্রাসায় সকলের পড়াশোনা করা সম্ভব ছিল না। মূলত মুসলিম সমাজের উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলেরাই কলকাতা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করত। এই প্রেক্ষিতে নিজেদের উদ্যোগে মূলত ধর্ম শিক্ষার জন্য ব্যাপক হারে মাদ্রাসা তৈরি হয়।

আরবের আব্দুল ওয়াহাবের অনুগামীরা ওয়াহাবি নামে পরিচিত। বাংলায় এরা ফারাজি বলে পরিচিত। কিন্তু সারা পৃথিবীর মতো এই দেশ ও এই রাজ্যে ওয়াহাবিদের সংখ্যা কম। এ রাজ্যে হানাফি (৭০ হিজরি সনে ইরাকে জন্ম হয় আবু হানাফির। তাঁর অনুগামীরাই হানাফি) সম্প্রদায়েরর সংখ্যা বেশি। এই সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতারা ব্রিটিশ শাসনকালেই উত্তর প্রদেশের দেওবন্দে একটি মাদ্রাসা তৈরি করেন। পশ্চিমবাংলায় বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মৌলানা তাহের, মাহমুদ হাসান, হোসেন আহমেদ মাদানির মতো দেওবন্দি মতে বিশ্বাসী মৌলানারা খারিজি মাদ্রাসা তৈরির ব্যাপারে মনোযোগী হন।

মূলত মুর্শিদাবাদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, নদিয়া প্রভৃতি জেলায় শয়ে শয়ে খারিজি মাদ্রাসা গড়ে ওঠে। একই সময়ে ফুরফুরা শরিফের ধর্মীয় নেতা আবু বক্কর সিদ্দিকীর হাত ধরে পশ্চিম বাংলায় খারিজি মাদ্রাসা তৈরির উদ্যোগ শুরু হয়। তিনি এবং শিষ্য মহম্মদ শহীদুল্লাহ, মৌলানা রুহুল আমিন প্রমুখের প্রচেষ্টার প্রচুর খারিজি মাদ্রাসা তৈরি হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই খারিজি মাদ্রাসা তৈরির একটা ঢেউ লক্ষ্য করা যায়। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র আদ্যোপান্ত ধর্ম নিরপেক্ষ। এখানে রাষ্ট্র তার শিক্ষা নীতি থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই কোনও ধর্মকে প্রাধান্য দেবে না। তাই নিজেদের পরিচিতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পুনরায় মাদ্রাসা তৈরি শুরু হয়।

সেই থেকেই পশ্চিম বাংলায় মুসলিম প্রভাবিত জেলাগুলিতে খারিজি মাদ্রাসার এত রমরমা। শুধু তাই নয় দিনের পর দিন এই সংখ্যা আরও বাড়ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের শিক্ষার হার বাড়ছে। মুসলিম সমাজের অগ্রসর অংশের মেয়েরা সাধারণ স্কুল-কলেজে পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু প্রান্তিক বাড়ির মেয়েরা স্কুলের পরিবর্তে খারিজি বা বেসরকারি মাদ্রাসায় পড়ছে। কিন্তু স্কুল বা সরকারি মাদ্রাসার পড়ার পরিবর্তে মুসলিম সমাজের একাংশ কেন খারিজি মাদ্রাসামুখী হচ্ছে?

ধর্মীয় ভীতি ও আর্থিক অনগ্রসরতা এর মূল কারণ। ধর্ম শিক্ষার মাধ্যমে নিজেকে পুণ্যবান করে তোলা যেতে পারে এই ধারণা থেকে অনেকেই নিজেদের ছেলে মেয়েদের খারিজি মাদ্রাসায় পড়াতে পাঠান। অনেক সম্পন্ন গেরস্থ বাড়ির অভিভাবকেরাও তাঁদের ছে‌লে মেয়েদের মাদ্রাসায় স্রেফ ধর্মীয় শিক্ষাটুকু নেওয়ার জন্য মাদ্রাসায় পাঠান। জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাদ্রাসার সংখ্যাও বাড়ছে। খারিজি মাদ্রাসাগুলি মূলত আবাসিক। থাকা-খাওয়া-ধর্মীয় শিক্ষা নেওয়া সবই হয় এক ছাদের তলায়। হদ্দ গরীর ঘরের বাবা-মা অনেক ক্ষেত্রেই সন্তানের ভরনপোষন ও শিক্ষা দীক্ষার খরচ বহনে অপারগ হয়ে ওঠে‌ন। তখন বাবা-মা তার সন্তানদের মাদ্রাসায় পড়তে পাঠান।

কারণ, খারিজি মাদ্রাসায় মাসে বড় জোর শ’ তিনেক টাকা মাসে দিলেই সন্তানের থাকা-পড়াশোনা সবই হয়ে যায়। আবার অনেক‌ ক্ষেত্রে অতি দরিদ্রদের কাছ থেকে কোনও টাকাই নেয় না মাদ্রাসাগুলি। কারা তৈরি করেন এই মাদ্রাসাগুলি?

গ্রামের দিকে কোনও অর্থবান ব্যক্তি ব্যবসা বা অন্য কোনও কারণে আর্থিক সচ্ছলতা লাভ করলে তিনি ধর্মীয় শিক্ষা প্রসারের কথা ভাবেন। এবং ব্যক্তি উদ্যোগেই গ্রাম ও আশপাশের এলাকার অসহায় ছেলে মেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি করেন মাদ্রাসা। এই মাদ্রাসাগুলি সম্পূর্ণ দানের টাকায় চলে। সম্পন্ন মুসলিমদের ঈদুজ্জোহাতে জাকাত (গরিবদের উদ্দেশ্যে সাহায্য) দেওয়া পালনীয় কর্তব্য। মাদ্রাসাগুলি মূলত এই জাকাতের টাকা অনুদান হিসেবে পেয়ে থাকে। এছাড়াও সারা বছরই গ্রামে গ্রামে ঘুরে মাদ্রাসার নামে সাহায্য চেয়ে বেড়ান এক শ্রেণির মৌলানারা। এছাড়াও বছরের কিছুদিন মাদ্রাসার পড়ুয়ারাও বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে মাদ্রাসার নামে সাহায্য চায়। এইভাবে মাদ্রাসাগুলি চলে।

মাদ্রাসাগুলিতে মূলত দুই প্রকারের ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়। এক, ধর্মগ্রন্থ না বুঝে মুখস্থ করানো হয়। সম্পূর্ণ কোরান মুখস্থ করার এই প্রক্রিয়াকে ব‌লা হয় হাফেজ। দুই, এক্ষেত্রে না বুঝে ধর্ম গ্রন্থের আগাপাশতলা মুখস্থের কোনও প্রয়োজ‌ন নেই। কোরানের অর্থ বোঝা, বিশ্লেষন করা, ধর্মীয় রীতিনীতি, ধর্মীয় দর্শন, হজরত মহম্মদের বাণী সম্বলিত বইয়ের ব্যাখা শেখানো হয় পড়ুয়াদের। প্রায় বারো বছর ধরে এই শিক্ষা শেষ করলে তবেই কেউ মৌলনা বা মৌলবি হন। তবে এখানে মাদ্রাসা হিসেবে পাঠ্যক্রমের ফারাক রয়েছে। পুরো বিষয়টা সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসা ঠিক করে। কী পড়ানো হবে, কতদিন ধরে পড়ানো হবে তা সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসা স্থির করে থাকে। অনেক মাদ্রাসা ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা-ইংরেজি-অঙ্ক শেখায়। আবার অনেক মাদ্রাসা ওই বিষয়গুলির প্রতি অতটা মনোযোগী নয়।

ফারাজি মতাদর্শে বিশ্বাসী মাদ্রাসাগুলি নবীর বাণী সম্বলিত বইগুলিকে চার বছর ধরে পড়ায়। অন্যদিকে হানাফি মতাদর্শে বিশ্বাসী মাদ্রাসাগুলি ওই একই বই পড়ায় মাত্র এক বছরে। এক্ষেত্রে বিশ্লেষন করা হয় হালকা ভাবে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় নিয়মের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। হানাফি পরিচালিত মাদ্রাসাগুলি নিজেরাই মৌলানা ডিগ্রি দেয়। অবশ্য এই ডিগ্রি সরকার স্বীকৃত নয়। কিন্তু সাধারণত, পশ্চিম বঙ্গের হানাফি প্রভাবিত মাদ্রাসাগুলি নিজেরা মৌলানা ডিগ্রি দেয় না।

এক্ষেত্রে পড়ুয়ারা এখানে ধর্ম সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা লাভ করে চলে যায় উত্তর প্রদেশের দেওবন্দে। সেখা‌‌নে পড়াশোনা করে মেলে ডিগ্রি। মৌলানা পাশ করে মূলত মসজিদে নমাজ পড়ানো ছাড়া কোনও কাজের সুযোগ নেই। অনেকে আবার নিজেরাই একটা মাদ্রাসা খুলে বসে। এই জন্য এখন অনেকেই মৌলানা পড়াশুনার পর সরকারি মাদ্রাসায় পড়াশুনা করছেন। যাতে ভবিষ্যতে আরবি সাহিত্যে সরকারি চাকরি পাওয়া যায়।

অন্য বিষয়গুলি:

Qawmi Madrasas Education System
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy