বৃষ্টি মানেই জল থইথই। তেহট্টের রুদ্রনগর প্রাথমিক স্কুলে। — নিজস্ব চিত্র
ছপ ছপ, ছপাং ছপাং ছপাং...
বই বগলে ছেলে চলেছে স্কুলে, মেয়ে চলেছে স্কুলে...
স্কুল আছে। পথ নেই। কোথায় মাঠ আর কোথায় পুকুর? যেতে যেতে ছেলে গেল তলিয়ে...
সবে বছর ঘুরেছে। সমশেরগঞ্জের মহব্বতপুর প্রাথমিক স্কুলের সামনে কোমর জলে তলিয়ে গিয়েছিল আট বছরের মানোয়ার হোসেন, সে তো গত বছর ১৫ জুলাইয়ের ঘটনা। ভয়ে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছিল গোটা গ্রাম। স্কুলে তালা পড়েছিল।
কিন্তু সে আর ক’দিন? এখনও এ রকম কত মানোয়ার রোজ স্কুলে যায় প্রাণ হাতে করে! ভয় কাটে না।
এই তো সে দিন অঝোর বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় বাবা আসাদুল মণ্ডলের হাত ধরে স্কুলে এসেছিল চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র শামিম। তেহট্টে রুদ্রনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনেটা তখন প্রায় পুকুর। দেখে আর ছেলেকে ছেড়ে যেতে সাহস পাননি আসাদুল। শিক্ষকদের জানিয়ে ছেলে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। তিনি তো একা নন, অনেকেই। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়, জল না নামা পর্যন্ত স্কুল বন্ধ রাখতে বাধ্য হন কর্তৃপক্ষ।
করিমপুর, চাপড়া, কৃষ্ণনগর, শান্তিপুর, হরিণঘাটা, চাকদহ, সুতি, বেলডাঙা, ধুলিয়ান— সর্বত্র একই ছবি। রুদ্রনগর স্কুলের পাশেই একটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র। সেখানে পড়তে যেতেও জল ভাঙতে হয় শিশুদের। ভারী বৃষ্টিতে জলে ভরে করিমপুর জগন্নাথ উচ্চ বিদ্যালয় চত্বরও।
বেলডাঙার বেতবেড়িয়া প্রাথমিক স্কুলে যাওয়ার রাস্তা ফি বর্ষায় পাশের ভাণ্ডারদহ বিলের জলে ডুবে যায়। এমনও অবস্থা হয় যে বাঁশ বেঁধে রাস্তা তৈরি করে পারাপার করতে হয় ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের।
সুতিঘাটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌঁছতে হলে পাকা রাস্তা ছড়ে ৬০০ মিটার কাঁচা রাস্তা দিয়ে যেতে হয়। তার অর্ধেকটা জলে ভরে থাকে। গত বছরও স্কুল বন্ধ ছিল টানা কয়েক দিন। সল্যাপাড়া প্রাথমিক স্কুল ও দেবপুর দক্ষিণপাড়া থমিক বিদ্যালয় যাওয়ার রাস্তাও খুব খারাপ। কাদায় পিছলে পড়ে জখম হয়েছেন অনেকেই।
রঘুনাথগঞ্জের জগদানন্দবাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার রাস্তাও গিলে খেয়েছে স্কুল লাগোয়া পুকুর। খেলার সময়ও তালাবন্ধ করে রাখতে হচ্ছে কচিকাঁচাদের। প্রধান শিক্ষক সত্যরঞ্জন দাস বলেন, “অঘটনের আশঙ্কায় মিড-ডে মিলের সময়েও পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় দুই শিক্ষককে। গার্ডওয়াল দেওয়ার জন্য বারবার শিক্ষা সংসদ থেকে পঞ্চায়েত সকলকে জানিয়েছি। সুরাহা হয়নি।” একই ভাবে, কুলোরি প্রাথমিক স্কুলেরও গা ঘেঁষে উঠে এসেছে পুকুর। পড়ুয়ারা যাতে জলের ধারে চলে না যায়, তার জন্য পালা করে পাহারা দেন শিক্ষকেরা।
খোদ কৃষ্ণনগর শহরের পল্লিশ্রীতে কাজী নজরুল পৌর প্রাথমিক স্কুলের পাশে রয়েছে কচুরিপানা ভরা পুকুর। বর্ষায় পুকুর উপচে জল চলে আসে স্কুল চত্বরে। গত বছরও জলডুবি স্কুলে বেশ কয়েক দিন ক্লাস বন্ধ রাখতে হয়েছিল। পুর প্রশাসন কী করছে? কৃষ্ণনগরের পুরপ্রধান অসীমকুমার সাহার আশ্বাস, বর্ষা গেলেই ওই স্কুলে পাঁচিল দেওয়া হবে।
নদিয়া জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলার ২৬১৭টি প্রাথমিক স্কুলের মধ্যে অন্তত শতাধিক পুকুর, খাল, জলাশয়, নদী, রাস্তার ধারে বা নিচু এলাকায়। স্কুলগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছে দাবি করে জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের চেয়ারম্যান রমাপ্রসাদ রায় বলেন, “নিচু স্কুলে মাটি ভরাট করে যেমন উচু করা হবে, তেমনি জলাশয় বা রাস্তার ধারে থাকা স্কুলগুলিতে পাঁচিল দেওয়া হবে।”
আশ্বাসে কি চিঁড়ে ভেজে?
মানোয়ার ডুবে যাওয়ার পরে মহব্বতপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে পঞ্চায়েত ও শিক্ষা দফতরের কর্তারা আশ্বাস দিয়েছিলেন, মাটি ফেলে স্কুল চত্বর উঁচু করে দেওয়া হবে। এক বর্ষা গিয়ে আর এক বর্যা এসেছে। কথাও ভেসে গিয়েছে।
এখনও স্কুলের পথে চলেছে ছোট ছোট পা... ছপাং ছপাং ছপাং...
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy