Advertisement
১১ জানুয়ারি ২০২৫

পুঁটলিতে গয়না, কেপমারে জেরবার যাত্রী

বাস থেকে নামতেই পড়িমড়ি করে ছুটে এসেছিল ছেলেটি— ‘‘বুবু (দিদি) আমার রিকশায় চলুন না, খোদা কসম হাফ ভাড়ায় নিয়ে যাব!’’ কিঞ্চিৎ হকচকিয়ে গেলেও সস্তার হাতছানিতে তাঁরা চড়ে বসেছিলেন ওই রিকশায়। কাল হয়েছিল সেটাই।

অঙ্কণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

অঙ্কণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

সুজাউদ্দিন
শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৫ ০১:৪১
Share: Save:

বাস থেকে নামতেই পড়িমড়ি করে ছুটে এসেছিল ছেলেটি— ‘‘বুবু (দিদি) আমার রিকশায় চলুন না, খোদা কসম হাফ ভাড়ায় নিয়ে যাব!’’

কিঞ্চিৎ হকচকিয়ে গেলেও সস্তার হাতছানিতে তাঁরা চড়ে বসেছিলেন ওই রিকশায়। কাল হয়েছিল সেটাই। মাঝ পথে আচমকা রিকশা দাঁড় করিয়ে রাস্তা থেকে একটা সাদা পুঁটলি কুড়িয়ে নিয়েছিল চালক ছেলেটি। তারপর দুই সওয়ারির সামনে তা খুলতেই বেরিয়ে পড়েছিল ঝকঝকে ‘সোনার’ গয়না।

চালকের কাকুতি মিনতিতে তা কিনতে দেরি করেননি তাঁরা। রফা হয়েছিল চার হাজার টাকায়। বাড়ি ফিরতেই অবশ্য ভুলটা মালুম হয়েছিল। আদ্যন্ত নকল গয়না।

বিশ-চল্লিশ টাকার দূরত্ব ‘হাফ’ ভাড়ায় পৌঁছে দেওয়ার টোপ দিয়ে কেপমারির এই নব্য-পন্থায় বছর দুয়েক ধরেই বিড়ম্বনায়, ফাঁদে পা দেওয়া আম আদমি এবং বহরমপুর থানার পুলিশ।

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, গত দু’বছরে এই ধরনের কেপমারির ঘটনা ১৯, তবে, গ্রেফতারের সংখ্যা এখনও শূন্য। কেন?

জেলা পুলিশের গোয়েন্দাদের অনুমান, এই ধরনের রিকশা চালকেরা সাধারনত কোনও নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডে দাঁড়ায় না। শহরের বাইরে থেকে এসে রিকশা ভাড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে হাসপাতাল, বাস স্ট্যান্ড কিংবা রেল স্টেশনের কাছাকাছি কোনও জায়গায়। অচেনা, অসহায় মুখই এদের লক্ষ্য। নকল গয়নার টোপ দিয়ে তারা মাঝ-বয়সী মহিলাদেরই ‘টার্গেট’ করে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। এ সব তথ্য হাতে পেয়েও গত দু’বছরে এক জনকেও ধরা গেল না?

জেলা গোয়েন্দা দফতররের এক কর্তা বলছেন, ‘‘কোনও অজুহাত দিচ্ছি না, প্রাথমিক ভাবে মেনে নিচ্ছি এটা আমাদের ব্যর্থতা।’’ তবে তাঁর ব্যাখ্যা— স্টেশন-স্ট্যান্ডের ভিড়ে কে আসল চালক আর কে-ই বা কেপমার তা অনুমান করা সহজ নয়। তা ছাড়া যে ক’টি ঘটনা ঘটেছে, সব ক’টিই করেছে বহরমপুরের বাইরে থাকা আসা কেপমারেরা। ফলে স্থানীয় সমাজবিরোধী কিংবা আটপৌরে কেপমারদের ধরে খুব একটা সুবিধা করা যায়নি। তবে তাঁর দাবি, ‘‘এ ব্যাপারে স্থানীয় বাসিন্দাদের সচেতনতার প্রশ্নটিও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এত সহজে ফাঁদে পা দিলে কী-ই বা করার আছে।’’

এই ধরনের অপরাধ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অরূপরতন বিশ্বাস। তিনি ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘সচেতনতার সঙ্গে শিক্ষা-রুচির প্রশ্নটিও এ ক্ষেত্রে জরুরি। লক্ষ্য করবেন, চিটফান্ডে যাঁরা টাকা রেখে সর্বস্বান্ত হয়েছেন তাঁদের অধিকাংশেরই প্রথাগত শিক্ষা তেমন জোরালো নয়।’’ তাঁর যুক্তি, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন না হওয়ায় লোভের ফাঁদে পা দিতেও তাঁরা দ্বিধা করছেন না। তিনি বলেন, ‘‘এটা ঠিক, অনেক শিক্ষিত মানুষও ফাটকা খেলতে এই ধরনের ফাঁদে পা দেন। তবে গ্রামীণ এলাকার এই সব মহিলারা ফাটকা নয়, নিপাট লোভের শিকার।’’

কেপমারের হাতে সর্বস্ব হারানোর পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের বাড়িতে, ক্ষতের উপর নুনের ছিটের মতো পারিবারিক অশান্তির মেঘও ঘনাচ্ছে। ইসলামপুরের এক মহিলা তাঁর অসুস্থ পুত্রকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে একই ভাবে কেপমারির শিকার হয়েছেন। বহরমপুরের টাউন সাব-ইন্সপেক্টর রবি মালাকার শোনাচ্ছেন সেই কাহিনী— ‘‘বছর কয়েক আগে ইসলামপুর এলাকার এক মহিলা তাঁর মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেকে নিয়ে ওই চক্রের ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। ছেলের চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা টাকা জলে গিয়েছিল তার। তাঁর কান্না দেখে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।’’ পুঁটলি ভর্তি সোনার গয়নার লোভে তিনি ছেলের চিকিৎসার জন্য কোঁচড়ে বাঁধা নগদ পাঁচ হাজার টাকা এমনকী কানের সোনার দুলও ওই কেপমার রিকশা চালকের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তার জেরে বাড়ির অশান্তি তাঁকে প্রায় একঘরে করেছিল বলেও জানা যায়।

ওই পুলিশ অফিসার জানান, সে সময় ‘সোর্স’ লাগিয়ে যাত্রী সেজে সাদা পোশাকের পুলিশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করেছিল ঠিকই, তবে আসল কেপমার ধরা পড়েনি।

বহরমপুরের পুর প্রধান নীলরতন আঢ্য বলেন, ‘‘ব্যাপারটা নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন। আমাদের কাছেও অভিযোগ এসেছে। বারবার পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। কিন্তু কেপমার ধরা পড়ছে কোথায়!’’

দু’বছরে সংখ্যাটা ১৯। তবে এটাও ঠিক, অনেকেই এই ভাবে ঠকার পরে আর পুলিশের কাছে নালিশ জানাতে আসেন না। এক পুলিশ কর্তার কথায়, ‘‘তাঁদের ধরণা, পুলিশে ছুঁয়ে আঠারো ঘা। একে তো সর্বস্ব গেল, তায় লজ্জা, এর পরেও পুলিশ!’’ তাই পুলিশে নথিভুক্ত ঘটনার বাইরেও যে বহরমপুর জুড়ে ওই কেপমারদের শিকার হয়েছেন অনেকেই, বলা বাহুল্য। কিন্তু উপশমের পথ বাতলাবেন কে? প্রশ্ন সেটাই।

অন্য বিষয়গুলি:

state news berhampore rickshaw van puller kepmars
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy