প্রতীকী ছবি।
‘ছেলেদের কাঁদতে নেই! কাঁদে মেয়েরা। তুই মেয়ে হয়ে জন্মালেই ভাল করতিস।’
কে বলেছিল, আজ আর মনে নেই। তবে কেউ না কেউ বলেছিল। বাবা হতে পারে, কোনও বন্ধু হতে পারে। কোনও পড়শি? হ্যাঁ, তা-ও হতে পারে। তবে বলেছিল। এটা আমার স্পষ্ট মনে আছে।
আমার সে দিন মনে হয়েছিল, এ আবার কেমন কথা! মানুষের হাসি পায়। হিসি পায়। প্রেম পায়। কবিতা পায়। তা হলে কান্না পাবে না কেন?
আচ্ছা, কান্নার আবার ছেলে-মেয়ে হয় নাকি! এই মনে হওয়াটা আজও একই রকম আছে। মাঝে মাঝে তাই প্রশ্নটা জাগে, হ্যাঁ, কাঁদতেও পারি।
তবে এখন, এই বয়সে এসে কোনও কারণে বা অকারণে কান্না পেলে একটু বৃষ্টির দরকার হয়। একটু আড়াল। হিপোক্রেসি? হবে হয়তো। কিন্তু ‘আয় বৃষ্টি’ বললেই তো আর ঝেঁপে নামে না। সে রাস্তা দায়িত্ব নিয়ে বন্ধ করে দিয়েছি আমি, আমরা। তাই ওয়াশরুমে (এখন লোকজন তো তা-ই বলে) ঢুকে শাওয়ার চালিয়ে নীচে কিছুক্ষণ দাঁড়াই। কাঁদি। কেঁদেই চলি। যতক্ষণ না দরজায় টোকা পড়ে, ‘কী গো, আর কতক্ষণ...?’
আজকাল আর বেশি জবাব দিতেও ইচ্ছে করে না। তর্ক করতে ল্যাদ লাগে। কী হবে, এ সব করে? অকারণে, চাট্টি শব্দদূষণ। লোকে বলে, বয়স একটা ব্যাপার! আমি শুনি। শুনেছি। অমুক বয়সের পরে লোকে ফের প্রেমে পড়ে। তমুক বয়সের পরে লোকের একটা ইয়ে হয়। বয়সের দোষ। আরও কত কিছু।
কিন্তু সে সব তো কথার কথা। একটা নিজের মতো করে তৈরি করে নেওয়া ব্যাকরণ, ছক, অজুহাত কিংবা ভূগোল। আর সেটা বা সেগুলোই যে নির্ভুল, এটা কে ঠিক করে দিল! কিন্তু হ্যাঁ, আমি একটা পরিবর্তন টের পাচ্ছি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে। আজকাল মনে হয়, ব্যাপারটা অনেকটা ঘড়ির মতো। মানে সেই বারোটার ঘরেই ফিরে আসা। আর সেই কারণে, জন্মদিনে যাঁরা ‘উইশ’ করেন, তাঁদের আমার ঈশ্বর বলে মনে হয়। কারণ, প্রতি বছর একটা নির্দিষ্ট দিনে তাঁরা আমাকে মনে করিয়ে দেন, সময়-গাছের ডালে আরও একটা পাতা ফুরিয়ে গেল।
মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, ভীষণ ভাবে বেঁচে থাকা। আর আয়নার সামনে দাঁড়ানো। আমি দাঁড়াই। তাতে একটা প্রতিবিম্ব দেখতে পাই। লজ্জা পাই না। ঘেন্না? নাহ্, তা-ও হয় না? ভয়? নাঃ! তবে হ্যাঁ, কষ্ট হয়। কথা না রাখার কষ্ট। কর্তব্য থেকে সরে আসার কষ্ট। যাঁরা আমার জন্য কত কিছু করেছেন, তাঁদের জন্য কিছু করতে না পারার কষ্ট। আমার গা থেকে ক্রমশ মেঠো গন্ধটা উবে যাওয়ার কষ্ট। তবে এত কষ্টের পরেও মনের মধ্যে আজও আমি টের পাই, সেই টলটলে দিঘি। ঢিল ছুড়লেই সেই জলজ শব্দ। তার পাড়ে হার না মানা সবুজ শ্যাওলা। সে সব সরিয়ে নেবে, ভুলিয়ে দেবে সাধ্যি কার!
আর সেই পিছল শ্যাওলায় পা পিছলে যায় মাঝে মধ্যেই। এই আজ যেমন। আছাড় খেলুম। চারপাশ অন্ধকার। তার পর ফের উঠে দাঁড়ালুম। পালালাম না, পালাচ্ছি না। কারণ, আমি পালালে তো খেলাটাই শেষ। আর কোন কবি যেন সেই কবেই বলে গিয়েছেন, মৃত্যু একটা মাদারিকা খেল, বেশ লোকজন টানে। তবে আমি অন্তত, এমন মৃত্যু-বিজ্ঞাপন করি না। কিন্তু খারাপ লাগে, যখন খবরের কাগজে পড়ি, প্রেমিক কিংবা প্রেমিকার উপরে অভিমান করে কে যেন আত্মহত্যা করেছে। তা-ও আবার লাইভ! বাবা-মায়ের উপরে অভিমান করে কে যেন গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছে। কে যেন বেছে নিয়েছে একমুঠো ঘুমের ওষুধ!
আহাম্মক কোথাকার! প্রাণ খুলে হাসতে পারিস, মিথ্যে বলতে পারিস, রাত জেগে চিঠি লিখতে পারিস, ঘেয়ো কুকুরের পশ্চাতে তেড়ে লাথি মারতে পারিস, পাগল দেখলেই অসম্মান করতে পারিস, অঙ্কে কম নম্বর পাওয়া সহপাঠীকে খিল্লি করতে পারিস, একটু পিছিয়ে পড়া সহকর্মীকে অকারণে অপমান করতে পারিস, আরও কত কী পারিস। আর কাঁদতে পারিস না? কাঁদার জন্য কোনও অজুহাত লাগে না, ইগো-র দরকার হয় না, সিপিএম-তৃণমূল-কংগ্রেস-বিজেপি-মার্কস (নম্বর) লাগে না। শুধু একটা ইচ্ছে থাকতে হয়। অকৃত্রিম। জ়েন্ডার যা-ই হোক না কেন, কান্নার স্বাদ তো সেই নোনতা! এক বার চেখে দেখলেই মালুম হত, পরের দিন সূর্যের রংটাই বদলে গিয়েছে! বদলে গিয়েছে জীবনের মানে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy