সন্তানকে হারিয়ে। ঝামালডাঙায়। নিজস্ব চিত্র
ভেজা দৃষ্টি দূরের দিকে মেলে বারান্দায় বসেছিলেন রাসমণি প্রামাণিক।
“ওরা দুই ভাই-বোন কেউ কাউকে ছাড়ত না। সব সময়ে এক সঙ্গে। আমার কোলও এক সঙ্গেই খালি করে চলে গেল”— বিলাপের মতো বলে যাচ্ছিলেন রাসমণি। দোলের দুপুরে পুকুরে স্নান করতে নেমে আর উঠতে পারেনি তাঁর দুই ছেলেমেয়ে— সানি আর স্নেহা।
বছর চোদ্দোর সানি আনন্দনগর হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র ছিল, বারো বছরের স্নেহা ওই স্কুলেরই ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। মঙ্গলবার উঠোনের এক কোণে মাথা নিচু করে বসে ছিলেন তাদের বাবা বাবলু প্রামাণিক। চাষাবাদ করে দুই ছেলেমেয়েকে পড়াচ্ছিলেন তিনি। পড়া শেষ হয়ে গেল।
সোমবার দুপুরেই রঙের উৎসব ম্লান হয়ে গিয়েছে তাহেরপুরের খিসমা পঞ্চায়েতের ঝামালডাঙা গ্রামে। চারটি ছেলেমেয়ে তলিয়ে গিয়েছে পুকুরে। তার পর থেকেই আর উনুনে হাঁড়ি চড়েনি অনেক বাড়িতেই। সেই থেকেই আত্মীয়-পড়শিরা ঘিরে রেখেছেন রাসমণিকে। বারান্দায় বসে বারবার সকলকে ছেলেমেয়েদের ছোটবেলার ছবি দেখাচ্ছেন তিনি। আর তার পরেই বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।
ঝামালডাঙা গ্রামের বুক চিরে চলে গিয়েছে বীরনগর থেকে আড়ংঘাটা যাওয়ার রাস্তা। সেই রাস্তার ধারেই তিনটি বাড়ি ঘিরে পাক খাচ্ছে সন্তান হারানোর শোক। সানি-স্নেহার সঙ্গেই এলাকার পুকুরে স্নান করতে গিয়েছিল বছর চোদ্দোর শুভজিৎ হালদার (১৪) আর এগারো বছরের রাখী হালদার। একই পাড়ায় তাদের বাড়ি। তারাও ফেরেনি। তাদের সঙ্গে আরও দু’টি নাবালক ছিল। তাদেরই এক জন পরে গ্রামে এসে খবর দেয়।
পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মাঝে-মধ্যে ছেলেমেয়েগুলো চাষের জমির শ্যালো পাম্পের জলে স্নান করত। কখনও পুকুরে নামেনি। সানি আর স্নেহার পিসেমশাই অশ্বিনী হালদার বলেন, “ওরা সাঁতার জানত না। পুকুরে যাওয়ার তো প্রশ্নই নেই।” সানিদের বাড়ি থেকে শ’পাঁচেক মিটার দূরে চাষের জমির পরে রয়েছে একটি পুকুর। সোমবার রং খেলার পরে সানিরা সেই দিকেই বাড়িয়েছিল।
দীর্ঘক্ষণ ছেলেমেয়েরা বাড়ি না-ফেরায় যখন খোঁজাখুঁজি শুরু হয়েছে, এলাকার একটি বাচ্চা এসে খবর দেয়, ওরা পুকুরে স্নান করতে নেমে আর উঠছে না। গাঁয়ের লোকজন ছুটে যান। পুকুরের ধারেই পড়ে ছিল চার জনের চটি। লোকজন জলে নেমে একে-একে চারটি নিথর দেহ তুলে আনেন। রাখীর মামা সুব্রত হালদার বলেন, “স্কুল ছুটি থাকলে ওরা শ্যালো পাম্পে গিয়ে স্নান করত। এ দিন সেটা বন্ধ ছিল। তাই হয়তো পুকুরে চলে যায়। কিন্তু সেটা আমাদের কারও নজরে পড়েনি।” রাখীর বয়স যখন দশ মাস, সেই সময়ে তার বাবা মারা যান। তার মা পরে আবার বিয়ে করেন। তাঁর এই পক্ষে একটি ছেলে আছে। তবে রাখীও থাকত তাঁর সঙ্গেই। সে বাড়ির সকলে প্রায় বাকরুদ্ধ।
সানিদের বাড়ি থেকে কয়েক পা এগিয়েই রাস্তার উল্টো দিকে বাড়ি তার বন্ধু শুভজিতের। উঠোনে বসে তা মা তপোরানী বিড়বিড় করে চলেছেন, “কালকেও এই সময়ে আমার ছেলেটা এই উঠোনে খেলা করে বেড়াচ্ছিল।” তাঁর স্বামী দিনমজুরি করেন। মেয়ে মিলি এই বছর উচ্চ মাধ্যমিক দিচ্ছে। আর ক’দিন বাদেই পরীক্ষা। কিন্তু সে পড়বে কেমন করে? তার কথায়, “এখন তো অন্য কিছু ভাবতেই পারছি না। ভাই এ ভাবে আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেল!”
সোমবার ঘটনার পরেই এলাকায় গিয়েছিলেন রানাঘাট ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তাপস ঘোষ। ময়নাতদন্তের পড়ে দেহ সৎকার ও বাকি সব বন্দোবস্ত তিনিই করেন। তাপস বলেন, “সন্তান হারানোর পরে কোনও সান্ত্বনাই যথেষ্ট নয়। তবু যতটা সম্ভব পাশে থাকছি। এলাকার মানুষও ওঁদের পাশে আছেন।” এ দিন রানাঘাট উত্তর-পূর্বের বিধায়ক শঙ্কর সিংহও গ্রামে যান।
শুধু মৃতদের পরিবার নয়, গাঁয়ের লোকজনও এ ধাক্কা সামলে উঠতে পারছেন না। ঝামালডাঙার বাসিন্দা অমল হালদার, সত্যেন হালদারেরা বলেন, “সব সময়ে যাদের চোখের সামনে খেলেধুলে বড় হয়ে উঠতে দেখেছি, তাদের শ্মশানে নিয়ে যেতে হবে তা কি ভেবেছিলাম? ওদের বাবা-মায়েদেরই বা কী বলে সান্ত্বনা দেব!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy