প্রতিবন্ধীরা ভোট দিচ্ছেন। ইসলামপুরে সাফিউল্লা ইসলামের তোলা ছবি।
ওঁরা চোখে দেখেন না। কিন্তু আঙুলে ছুঁয়ে বোঝেন। ভোটযন্ত্রের বোতাম তাই হয়ে উঠেছে সেফটিপিন, নষ্ট সিডি, ওয়াশার। আর ব্যালট বাক্স মাটির ভাঁড়। ভোটার মুর্শিদাবাদ জেলা প্রতিবন্ধী ইউনিয়নের সদস্যেরা।
ভৈরবের পাড়ে ফুটপথের ছোট্ট ছাউনি এঁদের ঠিকানা। কেউ অন্ধ, কেউ খোঁড়া, কেউ ১০০ শতাংশ শারীরিক প্রতিবন্ধী। সরকার গড়ার নির্বাচনে নিজে হাতে ভোট দেওয়া হয় না ওঁদের কোনও দিনই। নেতার চ্যালারা ওঁদের বুথে নিয়ে গিয়ে নিজেরাই বোতাম টিপে দেন।
কিন্তু বছরে এক বার নিজেদের সংগঠনের ভোটে তাঁরা নিজের হাতেই ভোট দেন। আর মহানন্দে মিষ্টিমুখ থেকে বিজয় মিছিল, সবই করেন। ভিক্ষা করে দিন গুজরান করলেও এই একটা দিন ওঁদের মতপ্রকাশের সুখ।
মূলত ভিক্ষা করেই চলে এঁদের সংসার ও সংগঠন। সেই সঙ্গে স্থানীয় প্রতিবন্ধীদের ভাল-মন্দ দেখাটা এই সংগঠনের কাজ। একটা সময়ে বেসরকারি বাসে তাঁদের আসন না দেওয়া নিয়ে জোর লড়াই করেছিলেন এঁরা। নানা দাবিতে প্রশাসনের কাছে হাজির হয়েছেন বার বার। সংগঠনের সদস্যদের বিয়ে থেকে অসুস্থতায় বাড়ি গিয়ে হাজির হন কর্তারা। ভিক্ষার একটা সামান্য অংশ জমাও হয় সংগঠনের তহবিলে। তা থেকে দেওয়া হয় শীতবস্ত্র।
সংগঠনের মুখপত্র গোপাল মণ্ডল জানালেন, তাঁদের মোট ভোটার সংখ্যা ১০০ হলেও এ বার ভোট দিয়েছেন ৫৮ জন। এ বারে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া গোলাম মোর্তজার জন্য বরাদ্দ ছিল বোতাম, তিনি ৫২টি ভোট পেয়েছেন। ফলে, দিন কয়েক বাদে সংগঠনের সম্পাদকের দায়িত্ব নেবেন তিনি। ৫০টি ভোট পাওয়া সরিফুলের বোতাম ছিল ওয়াশার। বাকি দুই প্রার্থী হাফিজুল ও রাসিদুল ইসলামের বোতাম সেফটিপিন এবং সিডি ক্যাসেটের ভাঙ্গা অংশ।
গোপালের কথায়, ‘‘সত্যি সত্যি ভোট দেওয়া আমাদের কপালে জোটে না কোনও দিন। কেউ না কেউ ধরে নিয়ে গিয়ে একটা জায়গায় দাঁড় করায় আর পিঁইক.... করে শব্দ হলেই বলে ‘চল, তোর ভোট হয়ে গিয়েছে।’ কিন্তু আমাদের সংগঠনের ভোট আমরা নিজে হাতেই দিই। আর তার জন্যই এমন ব্যবস্থা। যাতে প্রতীক হাতে ধরলে বুঝে যাই, কাকে ভোট দিচ্ছি।’’
রীতিমত লাইন দিয়ে ভোট। নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বটা পালন করেন স্থানীয় কংগ্রেস নেতা নারায়ণ দাস। তাঁর কথায়, ‘‘দুধুভাতু ভোট নয়! মনোনয়ন জমা থেকে প্রার্থীপদ তুলে নেওয়া এমনকী হুমকি ও ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগও আসে। খুব ঠাণ্ডা মাথায় সামলাতে হয়। ওরা তো সমাজে বঞ্চিত-লাঞ্ছিত। এখানে ফের বঞ্চনা হলে খুব কষ্ট পাবে।’’ সে কারণে স্থানীয় থানায় বলে পুলিশ রেখে এক জন প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগ করে খুব নিরপেক্ষ ভাবে ভোট নেওয়া হয়, জানান তিনি।
গোলাম মোর্তজার দাবি, ‘‘এই ভোট অনেকের কাছে ছেলেখেলা মনে হলেও আমাদের কাছে খুব সম্মানের। বছরে এক বার ভোট দিয়ে নিজেকে খুব গর্বিত মনে হয়। আসল ভোট না দিতে পারলেও এই ভোট দিয়েই আমরা খুব আনন্দ পাই।’’
ভোটের সঙ্গে আছে ভূরিভোজও। চা-টিফিন থেকে দুপুরে খাসির মাংস আর ভাত। ভোট মিটতেই জয়ীরা বিলিয়েছেন লাড্ডু। হয়েছে আবির খেলা ও বিজয় মিছিল। ৫০ ভোট পাওয়া সরিফুল ইসলামের কথায়, ‘‘ঝাক্কি কম নয়। মাসখানেক ধরে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে প্রচার করা হয়েছে। আগের সম্পাদক-সভাপতি যেমন টিঁকে থাকার লড়াই করেছে, আমরাও নতুন করে পদে বসার জন্য মরিয়া হয়ে লড়েছি। প্রায় ৫০০ টাকার লাড্ডু মিষ্টি বিতরণ করেছি আমরা।’’
ইসলামপুর থানার এক পুলিশ কর্মী বলেন, ‘‘আমাদের থানার সামনেই ওঁদের অফিস। প্রায়ই ওঁদের সঙ্গে দেখা হয়, ওঁদের অফিসের সামনেই চলে আমাদের টহল। এ দিন বিকেলে দেখি, মিষ্টি হাতে হাজির ওঁরা। নতুন সম্পাদক-সভাপতিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে এলাম।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy