Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

মুক্তির প্রতীক কাপ-ডিশ, এঁকে দিলেন বহরমপুরের মনোরোগীরা

কারও পতাকায় কালো ফুল, কারও উজ্জ্বল মোমবাতি। কারও চশমা, কারও উড়ন্ত পাখি, রঙিন প্রজাপতি, এমনকী চায়ের কাপডিশ! বহরমপুর মানসিক হাসপাতালের রোগীদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, এই মানসিক হাসপাতাল যদি একটা রাষ্ট্র হতো আর আপনি তার নাগরিক, তবে কেমন হতো আপনার পতাকা?

ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

শুভাশিস সৈয়দ
বহরমপুর শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৫ ০০:২০
Share: Save:

কারও পতাকায় কালো ফুল, কারও উজ্জ্বল মোমবাতি। কারও চশমা, কারও উড়ন্ত পাখি, রঙিন প্রজাপতি, এমনকী চায়ের কাপডিশ!

বহরমপুর মানসিক হাসপাতালের রোগীদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, এই মানসিক হাসপাতাল যদি একটা রাষ্ট্র হতো আর আপনি তার নাগরিক, তবে কেমন হতো আপনার পতাকা?

তাতেই বেরিয়ে এসেছে ওই সব রং, ছবি, নকশা।

হাসপাতালের বন্দিদশায় এক ঝলক খোলা হাওয়া আনতে ফি বছর ১৫ অগস্ট বহরমপুর মানসিক হাসপাতালে অনুষ্ঠান করে ‘অঞ্জলি’ সংস্থা। তার কর্ণধার রত্নাবলী রায় বলেন, ‘‘আমরা ওদের বলি, যদি হাসপাতাল হতো তোমার দেশ, তা হলে কেমন হতো তোমার পতাকা, তা তৈরি করো। তাঁদের তৈরি পতাকা দিয়েই অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছে।’’ বহির্বিভাগের উপরে দোতলার একটি ঘরে সেই অনুষ্ঠান। তেরঙা নয়, আবাসিকদের তৈরি ওই সব পতাকায় সেই ঘর ঠাসা।

হাসপাতালের বড় লোহার ফটক পেরিয়ে বাঁ দিকে শান বাঁধানো গোল বেদি। মধ্যে এক কাতে হেলে থাকা মরা গাছ। তার গায়ে ঠেস দিযে রাখা পুরনো দিনের কাঠের শার্সি দেওয়া ভাঙা জানালা, যে জানালা দিয়ে সকলে আকাশ দেখতে পায়, যা না কি স্বাধীনতার প্রতীক। গাছের উপর থেকে টাঙানো আবাসিকদের তৈরি পতাকা। আর প্রায় খান চল্লিশেক আইভরি কাগজের উপরে আঁকা মুখ, যে সব মুখে বিষণ্ণতার ছায়া স্পষ্ট। প্রতিটি মুখে একটি করে কান। কারণ আবাসিকদের ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনও মূল্য দেওয়া হয় না। তাই এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেওয়ার উপায়ও কারও থাকে না। এক কানে যা শোনে, তা-ই তাঁদের মেনে চলতে হয়।

এই দমবন্ধ করা পরিবেশে থাকতে থাকতে আবাসিকদের য়ে স্বাধীনতার বোধ তৈরি হয়েছে, তা-ই পতাকার নকশায় প্রকাশ পেয়েছে। হলুদ রঙের কাপড়ে কালো ফুল এঁকেছেন যিনি, তাঁর ব্যাখ্যা— এক সময়ে তাঁর জীবন রঙিন ছিল। হাসপাতালে থাকতে থাকতে বিবর্ণ হয়ে শুকিয়ে কালো হয়ে গিয়েছে। আবার রঙিন ফুলের মতো জীবন তিনি ফিরে পেতে চান।

যিনি মোমবাতি এঁকেছেন, তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘মোমবাতির মত জ্বলছি। এক দিন গলতে গলতে নিভে যাব।’’ যিনি চশমা এঁকেছেন তাঁর কাছে স্বাধীনতা মানে সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পাওয়া। হাসপাতালে অ্যালুমিনিয়ামের থালায় চা খেতে দেওয়া হয়। গরম চা খেতে গিয়ে অনেক সময়ে গায়েও পড়ে। বহু দিন হল কাপডিশে চা খাননি এক আবাসিক। তাই তাঁর কাছে স্বাধীনতা মানে কাপডিশে চা খাওয়া।

অনুষ্ঠানে মতামত জানানোর জন্য জনা পঞ্চাশেক আবাসিক হাজির ছিলেন। তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে এক মহিলা বলেন, ‘‘আমাদের যে খাবার দেওয়া হয়, তার গুণগত মান ভাল নয়। আমাদের সঙ্গে বসে এক দিন খেয়ে আপনারাও দেখুন, খাবার মুখে রোচে কি না!’’ মঞ্চে তখন বসে মুর্শিদাবাদের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক শুভাশিস সাহা ও হাসপাতাল সুপার পবিত্র সরকার। সুপার কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে পড়ে যান। পরে বক্তব্য রাখতে উঠে তাঁর মন্তব্য, ‘‘যিনি বলে গেলেন খাবারের গুণগত মান ভাল নয়, তাঁকে দেখে কিন্তু বেশ ফুটফুটে মনে হচ্ছে!’’

শুধু কর্তারই যে এমন প্রতিক্রিয়া তা নয়। হাসপাতালের অব্যবস্থা নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খোলায় অনুষ্ঠানের পরে নার্স থেকে বিভিন্ন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী আবাসিকদের হুমকি দেন বলেও অভিযোগ। যা শুনে রত্নাবলী বলেন, ‘‘আবাসিকদের কণ্ঠস্বর তৈরি হোক, তা আসলে কর্তৃপক্ষ চান না। তাই সুপারের নেতৃত্বে এক শ্রেণির কর্মী সন্ত্রাস ও ভয়ের বাতাবরণ সৃষ্টি করতে চাইছেন। আবাসিকদের মনের কথা শোনার মত সহ্য ও ধৈর্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেখানো উচিত।’’

সুপার অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, ‘‘হাসপাতালের কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যে রটনা হচ্ছে। হাসপাতালের সীমাবদ্ধতার মধ্যে ওই আবাসিকেরা সকলেই স্বাধীন।’’ তাঁঅ দাবি, বহরমপুর মানসিক হাসপাতালে যে খাবার দেওয়া হয়, তা ‘মডেল মেনু’ হিসেবে ধরে সরকার রাজ্যের সমস্ত মানসিক হাসপাতালে তা চালু করার কথা ঘোষণা করেছে। থালায় চা প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘আসলে অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাসে চা দেওয়া হয়, কিন্তু কিছু গ্লাস কম পড়েছে। নতুন করে তা কেনার ব্যবস্থা হচ্ছে।’’

জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অবশ্য বলেন, ‘‘খাবারের বিষয়টি আমি শুনেছি। সরবরাহের দায়িত্বে যিনি রয়েছেন, তাঁকে ডেকে কড়া ভাবে জানিয়ে দেওয়া হবে। আমাদের নজরদারিও চালাতে হবে। আমি ওই আবাসিককে বলেছি, কাউকে কিছু না জানিয়ে এক দিন হঠাৎ হাসপাতালে চলে এসে তোমাদের সঙ্গে খাব।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy