শোভাযাত্রা। নিজস্ব চিত্র
তখন আশির দশক। বাংলা বছরের শেষ দিন এবং নববর্ষের প্রথম দিনে স্থানীয় গোয়ালা সম্প্রদায়ের মানুষেরা তাঁদের গৃহপালিত গরুদের বিশ্রাম দিতেন। পোষ্যদের স্নান করিয়ে কপালে সিঁদুরের টিকা দেওয়া হত। বিকেল বেলায় ওদের সাজিয়ে এলাকায় বের হত শোভাযাত্রা। পোশাকি নাম ‘গোষ্ঠ বিহার যাত্রা’।
এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে গ্রামবাংলার বর্ষবরণের আপন সংস্কৃতি। আশির দশকে এই গোষ্ঠ বিহার যাত্রায় যেমন সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ রদ নিয়ে সামাজিক বার্তা দেওয়া হত, তেমনই থাকত বিধবা বিবাহের পক্ষে সচেতনতা প্রচারও। এর পর নয়ের দশক এলে সামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে জুড়ল রাজনীতি। গোষ্ঠ বিহার যাত্রায় তখন বিভিন্ন সরকারি প্রচার কিংবা সরকারের গঠনমূলক কর্মসূচি তুলে ধরা হত। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অবদানও স্থান পেত এখানে।
এর পর ভাগীরথী-চূর্ণী দিয়ে গড়িয়েছে অনেক জল। আজ গোষ্ঠ বিহার যাত্রায় মিশেছে আধুনিকতা। নাম বদলেছে শোভাযাত্রারও। এখন নববর্ষের প্রথম দিনে ময়ূরপঙ্খী সহযোগে শোভাযাত্রাই পরিচিতি লাভ করেছে। ময়ূরপঙ্খী নামকরণ নিয়েও রয়েছে ভিন্নমত। অনেকেই বলেন, শোভাযাত্রার শুরুতে সুসজ্জিত যে গরুর গাড়িটি রাখা হয়, তার ওপর কৃত্রিম পেখম মেলা ময়ূরের অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়। আর এর থেকেই শোভাযাত্রার নামকরণ ‘ময়ূরপঙ্খী’। তাসা ব্যান্ডপার্টির জায়গায় যুক্ত হয়েছে চোখ-ধাঁধানো আলোর ঝলকানি, সঙ্গে ট্যাবলো এবং অবশ্যই ডিজ়ে শব্দদানব। কালের স্রোতে রানাঘাট, বীরনগরের গোয়ালা সম্প্রদায়ের মানুষদের এই শোভাযাত্রায় ধীরে ধীরে ম্লান হয়েছে বিভিন্ন মূর্তির মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা প্রদর্শন কিংবা হর-গৌরীর উপাখ্যান।
একটা সময়ে যখন ১০-১২টি পাড়া থেকে গোষ্ঠ বিহারের শোভাযাত্রা বের হত, আজ সেই সংখ্যাই নেমে দাঁড়িয়েছে প্রায় চারটিতে। রানাঘাটের বাসিন্দা ইতিহাসের শিক্ষক রমেশ সর্দার বলেন, ‘‘এক সময়ে আমরা এই শোভাযাত্রায় কবিগান, তরজা গানের আসর বসতে দেখতাম। আজ তো কবিগান করার জন্য এক জন শিল্পীর সন্ধান পাওয়াই দুষ্কর।’’ তাঁর কথায়, ‘‘রানাঘাট শহরের দক্ষিণপাড়া এবং আনুলিয়া পঞ্চায়েতের সদগোপ পাড়া এলাকা থেকেই এই ধরনের শোভাযাত্রা বা ময়ূরপঙ্খী বের হয়।’’
শহরের প্রবীণদের অনেকেই জানাচ্ছেন, আগে এই শোভাযাত্রায় শিক্ষণীয় বার্তা থাকত। কিন্তু আজ সেই প্রচলন হারিয়েছে। মুঠোফোনে নিজস্বী কিংবা বুক কাঁপানো চটুল গানে লাগামহীন নৃত্য দেখে মনেই হয় না, এর সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা কোনও ভাবে সংযুক্ত। সমাজ কোন দিকে এগোচ্ছে, ভাবলেই আঁতকে উঠতে হয়।
পুরাতত্ত্ব গবেষক শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রানাঘাটে প্রচলিত ময়ূরপঙ্খী পুরাকালের যে ঐতিহ্য বহন করে, তা সম্ভবত সরাসরি সংযুক্ত ছিল গো-প্রতিপালক সম্প্রদায়ের দলপতিদের ময়ূরপঙ্খী নৌকায় ভ্রমণের সঙ্গে। ঐতিহাসিক ভাবে সরাসরি এর সম্পর্ক পালচৌধুরী জমিদার পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতার সঙ্গে। অন্য দিকে, আধ্যাত্মিক অর্থে গো-এর সঙ্গে ময়ূরের সম্পর্ক দেহতত্ত্বের এক বিশেষ প্রসঙ্গ নির্দেশ করে। সব মিলিয়েই আজকের ময়ূরপঙ্খী অতীতের অনেকগুলি ধারা এবং বিশ্বাসের সহাবস্থান।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy