মুর্শিদাবাদের নবগ্রামে ভোটের প্রচারে অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
গোটা দেশের কাছে তাঁর পরিচয়, রাষ্ট্রপতি। কেবল জঙ্গিপুরের কাছে প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রাক্তন সাংসদ। আর এই ভোটের মরসুমে সেই পরিচয়ই হয়ে উঠেছে প্রধান। লোকসভা নির্বাচনে যাবতীয় তর্ক-বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে প্রণববাবু। না থেকেও তিনি আছেন জঙ্গিপুরে।
একসময় জঙ্গিপুরে তাঁকে কেউ ডেকেছেন ‘দাদা’ বলে, কেউ ‘কাকু’। কেউ আবার এই সেদিনও ‘প্রণববাবু’ বলে দু’পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছেন। এখন দেশের ‘প্রোটোকলের’ শাসনে টেলিফোনেও তাঁকে ধরতে পারেন না এলাকার কংগ্রেস বিধায়ক মহম্মদ সোহরাব কিংবা আখরুজ্জামান। তবু নির্বাচনের প্রচারে কংগ্রেস বলছে তাঁর কথাই। শুধু তাঁর ছেলে অভিজিৎ এই কেন্দ্রের প্রার্থী বলেই নয়। প্রণববাবু জঙ্গিপুরের জন্য কী কী করেছেন, তার ফিরিস্তি দিয়ে ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টা করছেন কংগ্রেস নেতারা।
আর সেই সব দাবিকেই আক্রমণ করছেন বিরোধীরা। সিপিএমের মুজাফ্ফর হোসেনের কথায়, “আট বছর জঙ্গিপুরের সাংসদ ছিলেন প্রণববাবু। তিনি প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও ছিলেন। অথচ সেভাবে কোনও উন্নয়নই হয়নি জঙ্গিপুরে।” সিপিএম প্রার্থীর দাবি, বহু এলাকায় রাস্তার অত্যন্ত খারাপ। কোনও শিল্প গড়ে ওঠেনি, বাসিন্দাদের কর্মসংস্থান হয়নি। কেবল ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন কংগ্রেসের কিছু নেতা। মহকুমা শহরে মেয়েদের কোনও কলেজ নেই। উন্নতি হয়নি বিড়ি শ্রমিকদের। গঙ্গা-পদ্মার ভাঙনে আজও বিপর্যস্ত জঙ্গিপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা।
অনুন্নয়নের এমনই ফিরিস্তি দিচ্ছেন তৃণমূল প্রার্থী শেখ নুরুল ইসলামও। তিনি বলেন, “রাষ্ট্রপতি দেশের সাংবিধানিক প্রধান। তাঁকে নির্বাচনী প্রচারে আনা যায় না। কিন্তু তাঁর ছেলে থেকে অধীর চৌধুরী সকলেই রাষ্ট্রপতির নাম ব্যবহার করে ভোটে প্রচার করছেন। অথচ গোটা জঙ্গিপুর ঘুরে আমি হতবাক। কোথাও কোনও কাজ হয়নি।” তাঁর দাবি, রাজ্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দায় এড়াতে পারেন না এলাকার প্রাক্তন সাংসদরা। প্রণববাবু নিজে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক সামলেছেন। জেলার বেশির ভাগ পঞ্চায়েত ও জেলা পরিষদ কংগ্রেসের দখলে। তাঁর ব্যর্থতার জবাবদিহি কংগ্রেসকেই করতে হবে।
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর পাল্টা দাবি, প্রণববাবু এলাকার জন্য বহু কাজ করেছেন। জেলায় সেনা ছাউনি, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস হয়েছে। বহরমপুর দেশের একমাত্র জেলা শহর যেখানে পাসপোর্ট অফিস খোলা হয়েছে। তা হয়েছে প্রণববাবুরই উদ্যোগে। এমন কোনও ব্যাঙ্ক নেই যার শাখা জঙ্গিপুরে খোলা হয়নি। “যখনই সুযোগ এসেছে তখনই তিনি তা কাজে লাগিয়েছেন,” দাবি অধীরের।
স্থানীয় কংগ্রেস নেতারাও মেনে নিচ্ছেন, প্রণব-বিনা প্রচার নেই। সুতির কংগ্রেস সভাপতি আলফাজুদ্দিন বিশ্বাস বলেন, ‘‘লোকসভা নির্বাচন এলে আমরা চাই বা না চাই প্রণববাবুর কথা আসবেই। তাঁর ছেলেকেও বহু সময় তার জবাব দিতে হচ্ছে। নাজিরপুর, বহুতালিতে প্রচারে যেতেই মানুষ বলছেন প্রণববাবু ছিলেন বলেই না সুতির দু-দু’টো রাস্তা পাকা হয়েছে।” প্রণববাবু সাংসদ হয়ে এসে সীমান্ত উন্নয়ন তহবিল থেকে ৪০ কোটি টাকা মঞ্জুর করে দিয়েছেন সুতি ১ ব্লকের ওই দুই সড়ক নির্মাণের জন্য। কিন্তু সুতিরই উমরাপুর গ্রামে মানুষের ক্ষোভ, গ্রামের রাস্তাটা তো হয়নি। প্রণববাবু কি পারতেন না গ্রামের রাস্তাটা করে দিতে? এমন নানা প্রশ্ন উঠছেই। অধীরের বক্তব্য, “প্রণববাবু তো আর পঞ্চায়েতের প্রধান নন যে রাস্তায় রাস্তায় নলকূপ কিংবা সড়ক মেরামত করবেন। এটা মানুষকে বুঝতে হবে।”
জঙ্গিপুরে প্রথম নির্বাচনে লড়ার সময়ে প্রণববাবু যাঁর বাড়িতে থাকতেন, সেই মুক্তিপ্রসাদ ধর এখন তৃণমূুলের জেলা সম্পাদক। মুক্তিবাবু এখনও অবশ্য ‘প্রণবদার’ স্মৃতিতে আচ্ছন্ন। প্রণববাবু তখন যে ঘরে থাকতেন এখনও সেখানে সযত্নে আলমারিতে সাজানো আছে প্রণববাবুর রেখে যাওয়া চারটি বিগ্রহ। সেই সোফা, সেই খাট। দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে প্রণববাবুর একাধিক ছবি। তাঁর কথায়, ‘‘প্রণববাবু জঙ্গিপুরের সাংসদ ছিলেন আট বছর। জঙ্গিপুরের এমন কোনও এলাকা নেই যেখানে তিনি যাননি। অন্তত দেড়শো বার তিনি এসেছেন জঙ্গিপুরে। এলাকার বহু দলীয় বা বিরোধী ছোটোখাটো নেতাকেও তিনি মুখ দেখে চিনতেন।”
ছেলে অভিজিৎবাবুর প্লাস পয়েন্ট তাঁর বাবার এই ছত্রছায়াটাই। আবার মুশকিলও তাই নিয়ে, মনে করেন মুক্তিবাবু। নানা জায়গায় শুনতে হচ্ছে, প্রণববাবু বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য সেভাবে কিছু করেননি। এলাকায় কোনও শিল্প গড়ে ওঠেনি। মহকুমা শহর রঘুনাথগঞ্জে একটা স্কুল হয়নি। জঙ্গিপুরে এইমস ধাঁচে একটা হাসপাতাল গড়া কি খুব কঠিন ছিল তাঁর পক্ষে? রায়গঞ্জে জমি নিয়ে সমস্যা হলেও, জঙ্গিপুরে সে সমস্যা ছিল না। “তাঁর ছেলে যেখানে প্রার্থী সেখানে সে সব প্রশ্ন তো বেশি করে উঠবেই। তাই সব দলের প্রচারেই বার বার ঘুরে ফিরে আসছে তাঁর নাম,” বলেন তিনি।
অধীরের ব্যাখ্যা, “প্রণববাবু দেশের অন্যতম নীতি নির্ধারক ছিলেন। তার মধ্যে যখনই সুযোগ পেয়েছেন, জঙ্গিপুরের কথা ভেবেছেন। তাঁর মনপ্রাণ জুড়ে ছিল জঙ্গিপুর। জঙ্গিপুর তাঁকে সাংসদ হিসেবে জিতিয়ে যে সম্মান দিয়েছে তা কখনও ভোলেননি, সে কথা বারবার বলতেন প্রণবাবু।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy