সাংবাদিক বৈঠকে কেঁদে ফেললেন সৌমিত্র।
স্ত্রী সুজাতা কিছুক্ষণ আগে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। খবর পেয়েঘণ্টাখানেক নীরবেই ছিলেন বিজেপি সাংসদ তথা দলের রাজ্য যুব সভাপতি সৌমিত্র খাঁ। প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন জবাব দেওয়ার। কিন্তু উত্তর দিতে গিয়ে সাংবাদিক বৈঠকে বসে কেঁদে ভাসালেন সৌমিত্র। বিবাহবিচ্ছেদের নোটিস পাঠানোর ঘোষণা করেও সুজাতাকে প্রশ্ন করলেন, ‘‘আমি কি খুব পাপী?’’ রাজনীতির জন্য ভালোবাসাকে বিসর্জন দেওয়ার অভিযোগ তুলে কান্নাভেজা গলায় বললেন, ‘‘সুজাতা, খুব ভুল করলে। আর তুমি পদবিতে খাঁ লিখো না। শুধু মণ্ডল লিখো।’’
স্বামী-স্ত্রী’র ভিন্ন রাজনীতির জল গড়িয়ে গেল বিবাহবিচ্ছেদে!
স্বামী এক দলে স্ত্রী অন্য দলে, এমন নজির রাজনীতিতে একেবারে অমিল নয়। বাংলায় যেমন অভিনেতা-রাজনীতিক জয় বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপি করলেও তাঁর স্ত্রী অনন্যা তৃণমূলের কাউন্সিলার। তাঁরা অবশ্য একসঙ্গে থাকেন না। কিন্তু কেরলের গৌরী আম্মা এবং তাঁর স্বামী টি বি টমাসের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে উল্টো ছবি।। গৌরী ছিলেন সিপিএমের সদস্য। টমাস সিপিআইয়ের। রাজ্য সিপিএমের নেতা রবীন দেব জানাচ্ছেন, কিন্তু আলাদা আলাদা দল করলেও ১৯৫৭ থেকে ১৯৭৭ সালে টমাসের মৃত্যু পর্যন্ত তাঁদের দাম্পত্য অটুট ছিল। মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘দুটি মানুষ বৈবাহিক সম্পর্কে থাকলে তাঁদের সমস্ত ভাবনাচিন্তা ও মতাদর্শ একই পথে প্রবাহিত হবে, এ ভাবনার মধ্যে অনেক ভুল প্রত্যাশা রয়েছে। দুটি মানুষ। আসলে তো তাঁরা দুটি স্বাধীন ব্যক্তি। ফলে রাজনৈতিক মতাদর্শগত ফারাক তৈরি হলেও সম্পর্কের সেই বুনোটটা যদি থাকে, তা হলে তা অতিক্রম করে সম্পর্কটাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। যদি না তাঁদের মধ্যে এমনিতেই আগে থেকে অন্যান্য ভাঙন বা দূরত্ব এসে থাকে।’’ অনুত্তমার মতে, অনেক সময় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ক্ষেত্রে একটা ভাবনা তৈরি হয়। স্বামী-স্ত্রী দু’জন দুটি রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করলে সাধারণ মানুষ সেটাকে কী ভাবে নেবেন? মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব মনে হবে না তো? অনুত্তমার কথায়, ‘‘এ সব ভাবনা আসাই স্বাভাবিক। কিন্তু আলাদা আলাদা ভাবে রাজনৈতিক দল করাটাও সম্ভব। কারণ আমাদের মনে রাখা উচিত, বিবাহিত হলেও ওঁদের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য থাকবে। এটা মেনে নেওয়ার মতো জায়গাতেও আমরা অনেক সময় থাকি না।’’
আরও পড়ুন: বিজেপি দু’অঙ্ক ছাড়ালে টুইটার ছাড়ব, চ্যালেঞ্জ ছুড়লেন প্রশান্ত কিশোর
স্ত্রী-র দলবদলের কারণে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ‘বিবাহবিচ্ছেদ’-এর নোটিস পাঠানো সাম্প্রতিককালে বেনজির। একই সঙ্গে নাটকীয়ও। অতীতেও এমন ঘটনা ঘটেছে বলে রাজনীতির সঙ্গে জড়িতরা মনে করতে পারছেন না। বঙ্গের রাজনীতি শোভন চট্টোপাধ্যায়-বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়-রত্না চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কের ত্রিকোণ দেখেছে। ফলে ‘রাজনীতির রিয়েল লাইফ সোপ অপেরা’র খামতি ছিল সাম্প্রতিক অতীতে। শে সময়েও ক্ষেত্রেবিশেষে শোভনকে ছলোছলো চোখে দেখা গিয়েছে। কিন্তু সৌমিত্রর মতো কান্নায় ভেঙে পড়ার ‘লাইভ’ দৃশ্য বাঙালি এর আগে দেখেনি। সঙ্গে বাছা বাছা আবেগপ্রবণ মন্তব্য। যা সাধারণত চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হয়ে থাকে। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে বাংলার রাজনীতিতে প্রতিদিনই বহু নাটকীয মুহূর্ত এবং ঘাত-প্রতিঘাত তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সোমবার দুপুরে সৌমিত্র-সুজাতার কাহিনি সাম্প্রতিককালে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল। যাবতীয় নাটকীয়তা ছাপিয়ে এই মৌখিক বিবাহবিচ্ছেদ সবচেয়ে বেশি ‘টিআরপি’ খেয়ে নিচ্ছে।
সোমবার দুপুর ১টায় তৃণমূলের প্রবীণ নেতা সৌগত রায় সৌমিত্রর স্ত্রী সুজাতার হাতে দলীয় পতাকা তুলে দেন। তার পর সুজাতা বলেন, ‘‘একটা চ্যালেঞ্জ নিলাম। কারণ, বিজেপি-র হয়ে প্রচুর লড়াই করেছি। কোনও নিরাপত্তা ছাড়া নিজের প্রাণ বাজি রেখে লড়াই করেছি। কিন্তু বিজেপি তার জন্য কোনও সম্মান দেয়নি।’’ এর ঠিক এক ঘণ্টা পরে দুপুর ২টোয় সল্টলেকে নিজের বাসভবনে সাংবাদিক বৈঠক করেন সৌমিত্র। কিন্তু তাতে রাজনীতির কথার চেয়ে অনেক বেশি ছিল সৌমিত্র-সুজাতা দাম্পত্যের কথা। নানা ভুল বোঝবুঝির কাহিনি। স্বামী-স্ত্রীর কলহ এবং তার জেরে বেশ কিছুদিন কথা বন্ধ হয়ে থাকার ইতিহাসও।
আরও পড়ুন: সৌমিত্র-সুজাতা, দলত্যাগের জল গড়িয়ে গেল ডিভোর্স নোটিসে
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে সৌমিত্র নিজের কেন্দ্র বিষ্ণুপুর যেতে পারেননি আইনি বাধায়। তাঁকে জেতানোর পিছনে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন সুজাতা। সোমবার সেই সব দিনের কথা বলতেও বলতেও চোখের জলে ভাসেন সৌমিত্র। একই সঙ্গে সুজাতার প্রতি বার্তা দেন, ‘‘রাজনীতির তুমি কিছুই বোঝো না। সৌমিত্র না হলে তোমায় কেউ চিনত না।’’ এ-ও বলেন যে, সুজাতার জন্য দলীয় ভাবে বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জন্যই তাঁর জয় হয়েছিল বিষ্ণুপুরে। তাতে কারও একক কৃতিত্ব ছিল না। আবেগঘন কণ্ঠে সৌমিত্র বলেন, ‘‘নির্বাচনের সময় আমি গৃহবন্দি ছিলাম। তুমি পাশে ছিল। সেটা আমি ভুলব না।’’
এইটুকু রাজনীতির কথা হলেও ১০ বছরের সম্পর্ক ভাঙার দিনে বিমর্ষ এবং বিহ্বল ছিলেন সৌমিত্র। খানিকটা ভাবুক গলায় তিনি সাংবাদিক বৈঠকে বসেই স্বগতোক্তি করেন, ‘‘রাজনীতির জন্য এত ভালবাসা মিথ্যা হয়ে গেল?’’ সম্পর্কের ১০ টা বছর যে তিনি সুজাতা বলতে ‘পাগল’ ছিলেন, সৌমিত্র তা-ও সাংবাদিক বৈঠকে গোপন করেননি। ফিরিস্তি দিয়েছেন,গত ১০ বছরে স্ত্রী-র জন্য কী কী করেছেন। আর সব শেষে অশ্রুসজল কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘‘সুজাতা,আমি তোমায় মুক্তি দিলাম। সম্পূর্ণ ভাবে মুক্তি দিচ্ছি। আর পিছুটান রইল না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy