Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

হাতে সময় নিয়ে হবু মায়েরা হাসপাতালে

অনেকগুলো বছর পেরিয়েছে, কিন্তু দিনটা মনে পড়লে এখনও শিউরে ওঠেন মধ্যবয়সী প্রমীলা মণ্ডল।

ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
গোসাবা শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৬ ০৩:০২
Share: Save:

অনেকগুলো বছর পেরিয়েছে, কিন্তু দিনটা মনে পড়লে এখনও শিউরে ওঠেন মধ্যবয়সী প্রমীলা মণ্ডল।

যমজ বাচ্চা ছিল পেটে। সন্ধে ছ’টা থেকে প্রসবযন্ত্রণা শুরু হল। পাড়ার দাই এসে জানালেন, পেটের ভিতর দু’টো বাচ্চা দু’দিকে ঘুরে গিয়েছে। অথচ হাসপাতালে গিয়ে অস্ত্রোপচার করানোর উপায় নেই। কারণ, সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপ লাহিড়ীপুরের শান্তিগাছি গ্রাম থেকে সবচেয়ে কাছের হাসপাতাল গোসাবায় আসতেই এক বার খেয়া আর দু’বার ভ্যানে চড়তে হয়। সময় লাগে প্রায় ঘণ্টা আড়াই। রাতের দিকে খেয়া বা ভ্যান জোটেও না। বর্ষায় জল-কাদায় আরও শোচনীয় দশা।

সুন্দরবনের বহু এলাকাতেই ছবিটা এ রকম। সপ্তাহে একদিন ছাড়া খেয়াও চলে না অনেক জায়গায়। ফলে দীর্ঘদিন অবধি প্রসূতিরা হাসপাতালে যাওয়ার চেষ্টাই করতেন না। বাচ্চা হতো বাড়িতে, দাইয়ের হাতে বা হাতুড়ে ডাক্তারের ভরসায়। সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনাও বিরল ছিল না। অনেকে আবার প্রসব-জটিলতায় বাধ্য হয়ে সুদীর্ঘ-দুর্গম নদীপথ পেরিয়ে হাসপাতালে যেতে গিয়ে মাঝপথেই শেষ হয়ে যেতেন।

প্রমীলা অবশ্য কপাল জোরে বেঁচে গিয়েছিলেন। দেড় দিন যন্ত্রণায় আধমরা হয়ে গোঙানোর পরে তাঁর একটি বাচ্চার মাথা আগে বেরিয়েছিল, আর এক জনের পা।

প্রমীলা যা পাননি, তাঁর বড় মেয়ে তুলসী কিন্তু পেয়েছেন। প্রসবের জন্য সরকারি হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছেন তিনি। গোসাবা ব্লক প্রাথমিক হাসপাতাল চত্বরে নতুন তৈরি হওয়া ‘মাদার্স ওয়েটিং হাট’-এর ঘরে পরিচ্ছন্ন বিছানায় মেয়ের পাশে বসে তাই স্বস্তির হাসি হাসছিলেন প্রমীলা।

শান্তিগাছি থেকে গোসাবা পৌঁছনোর পথ কি তবে বদলে গেল? না, গোসাবা থেকে আজও খেয়া পার হয়ে সাতজেলিয়া গিয়ে সেখান থেকে ভ্যানে দেড় ঘণ্টা গেলে লাক্সবাগান। সেখান থেকে আবার ভ্যান পাল্টে এক ঘণ্টা গিয়ে পৌঁছতে হয় শান্তিগাছি। কিন্তু তুলসীরা যাতে আগেভাগেই হাতে সময় নিয়ে হাসপাতালে চলে আসতে পারেন, তার জন্য হাসপাতালেই খোলা হয়েছে প্রতীক্ষাগৃহ। তুলসীরা এখন প্রসব যন্ত্রণা শুরু হওয়ার দিন কয়েক আগে থেকেই হাসপাতালে এসে ‘প্রসূতি অপেক্ষা-ঘরে’ ভর্তি থাকছেন। তার পর নির্দিষ্ট সময়ে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে হাসপাতালেই প্রসব হচ্ছে।

কন্যাশ্রী, ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান বা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের মতো এই ‘মাদার্স ওয়েটিং হাট’ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্ভাবন। ফেব্রুয়ারি মাসে নবান্নে স্বাস্থ্যকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বিষয়টি সামনে এনেছিলেন তিনি। মনে করিয়েছিলেন, প্রত্যন্ত এলাকার মায়েদের হাসপাতালে নিয়ে আসা যাচ্ছে না বলেই রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার প্রসূতিদের় চিকিৎসা ও পুষ্টি সংক্রান্ত প্রকল্পগুলির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দরিদ্র প্রসূতিরা। তাই মমতার প্রস্তাব ছিল, প্রত্যন্ত এলাকায় সরকারি হাসপাতালের পাশেই বানাতে হবে আসন্নপ্রসবাদের প্রতীক্ষাগৃহ বা ওয়েটিং হাট। যে সব প্রসূতির বাড়ি একেবারে দুর্গম এলাকায়, সেখান থেকে তাঁদের ওই তারিখের দিন দশেক আগেই ভর্তি করা হবে প্রতীক্ষাগৃহে। সেখানে তাঁরা খাবার- শয্যা পাবেন, যত্ন পাবেন, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা পাবেন। সুরক্ষিত থাকবে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য।

মুখ্যমন্ত্রী বলার তিন মাসের মধ্যে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছিল। প্রথম দফায় গত ১ জুন খুলে গিয়েছিল রাজ্যের প্রথম তিনটি ‘মাদার্স ওয়েটিং হাট’। ১০টি করে শয্যা। তিনটিই সুন্দরবনের অতি দুর্গম অঞ্চলে। একটি গোসাবায়, একটি সন্দেশখালিতে আর একটি পাথরপ্রতিমায়। কেন্দ্রগুলি চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দু’টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে। গত দু’মাসের মধ্যেই গোসাবার ওয়েটিং হাটে আসা ৪২ জন প্রসূতির প্রসব হয়েছে ওখানকার হাসপাতালে। পাথরপ্রতিমায় সংখ্যাটা ২৪ আর সন্দেশখালিতে ২২।

স্বাস্থ্য দফতরের রিপোর্টই বলছে— সুন্দরবনের ৯টি দ্বীপে কুমিরমারি, সাতজেলিয়া, ছোট মোল্লাখালি, লাহিড়ীপুর, কচুখালি, আমতলি, পাঠানখালি, আমলামিথি, রাঙাবেলিয়া-র মতো ১৪টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার মধ্যে সরকারি হাসপাতাল বলতে গোসাবা ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। আবার বীরমজুর, খুলনা, মণিপুরের মতো অঞ্চলে একমাত্র ভরসা সন্দেশখালির কেন্দ্রটি। সুন্দরবনের এই প্রান্তগুলিতে গত বছর পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালে এসে প্রসবের হার ছিল মাত্র ৩৫ শতাংশ। প্রতীক্ষাগৃহ চালু হওয়ার পরে দু’মাসের মধ্যে তা একলাফে ৭০ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে। প্রসূতিকে পরীক্ষা করে প্রসবের আনুমানিক তারিখ জানিয়ে দেন আশা-কর্মীরাই। তার পর তাঁরা ধীরেসুস্থে চলে আসেন প্রতীক্ষাগৃহে। ঝাউখালির মল্লিকা মণ্ডল, রাঙাবেলিয়ার রিয়া প্রধান, কচুখালির সন্ধ্যা গায়েন, সাতজেলিয়ার চন্দনা তরফদারেরা উজ্জ্বল মুখে জানাচ্ছিলেন, দু’টো বাঁশের মাঝখানে বাঁধা মাদুরে প্রসব-ব্যথায় কুঁকড়ে শুয়ে কাদা-জঙ্গল-নদী পেরিয়ে হাসপাতালে আসার আতঙ্ক মুছে গিয়েছে এখানে এসে।

ভাত-ডাল-তরকারি-মাছের ঝোল খেতে-খেতেই মল্লিকা জানালেন, তাঁর বাড়ি যেতে হলে গোসাবা থেকে খেয়া পার হয়ে যেতে হবে মন্মথনগর। সেখান থেকে দু’ঘণ্টা ভ্যানে চেপে বেলতলি। সেখান থেকে আবার দেড়ঘণ্টা ভ্যানে গিয়ে তাঁর বাড়ি। পাড়ার কত মেয়েকে নিজের চোখে বাচ্চা হতে গিয়ে মারা যেতে দেখেছেন। সেখানে নিজে এক সপ্তাহ আগে থেকে হাসপাতালে থাকতে পাচ্ছেন, ফ্যানের হাওয়া-পরিষ্কার বিছানা-ওষুধ পাচ্ছেন! সময় সময় নার্স-দিদিরা এসে দফায় দফায় পরীক্ষা করে যাচ্ছেন! লজ্জা-লজ্জা মুখ নিয়ে মল্লিকা জানালেন, কোনও দিন কল্পনা করেননি এ সব।কিন্তু সকলের ভাগ্যই কি এত ভাল? নতুন পরিকাঠামোর সঙ্গেই যে জন্ম নিচ্ছে নতুন প্রত্যাশা, নতুন জটিলতাও।

(চলবে)

অন্য বিষয়গুলি:

Mother's waiting hut Pregnancy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy