হাই কোর্টে যাওয়ার আগে নির্যাতিতার মূর্তির সামনে। শুক্রবার কামদুনিতে। —নিজস্ব চিত্র।
ভিড়ে ঠাসা এজলাসে সদ্য রায় ঘোষণা করছেন কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী এবং বিচারপতি অজয়কুমার গুপ্ত। কামদুনির মৃতার পরিজনের চোখে তখন স্পষ্ট হতাশা।
রায়দান শেষ হতেই এজলাসের বাইরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন মৃতার মা-বাবা। বুকফাটা আর্তনাদ করতে করতে মৃতার মা বলছিলেন, ‘‘এ কী রায় হল! আমার মেয়ে কি ন্যায্য বিচার পাবে না?’’ কামদুনির ‘মাস্টারমশাই’ প্রদীপ মুখোপাধ্যায় সন্তানহারা মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছিলেন, ‘‘আমরা সুপ্রিম কোর্টে যাব। ন্যায্য বিচার নিয়ে আসব।’’ হতাশা, ক্ষোভ, দুঃখে ফেটে পড়ছিলেন মৃতার বাবা, দাদা। দু’জন পুলিশকর্মী এসে রীতিমতো রূঢ় স্বরে তাঁদের আদালতের বাইরে যেতে নির্দেশ দেন। হতাশা চেপেই হাই কোর্টের উঠোনে চলে আসেন মৃতার পরিবার এবং কামদুনির দুই প্রতিবাদী মুখ মৌসুমি কয়াল এবং টুম্পা কয়াল। তাঁদের পাশে ভিড় জমান হাই কোর্টে আসা বহু সাধারণ মানুষও।
ঘটনার পর থেকেই পুলিশের উপরে ক্ষুব্ধ ছিল মৃতার পরিবার-সহ গোটা কামদুনি। দুষ্কৃতীদের চিহ্নিত করা, গ্রেফতারে দেরির অভিযোগ ওঠে। বারাসত থানার থেকে তদন্ত ভার নেয় সিআইডি। প্রথমে খুন, পরে ধর্ষণ এবং গণধর্ষণের অভিযোগ এবং সেই ধারা দিতেও পুলিশ টালবাহানা করে বলে অভিযোগ।
দেহ উদ্ধারে আসে বাধা। দেহ রাস্তায় রেখে বিক্ষোভের সময়েও পুলিশের সঙ্গে বাদানুবাদ, ধাক্কাধাক্কি হয়। ঘটনার পরেই বারাসত থানা ভেঙে চারটি থানা করা হয়। কামদুনি চলে যায় বারাসত থানা থেকে রাজারহাটে। রায় শেষে মৃতার পরিজন পুলিশের ব্যবহার নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। হাই কোর্ট চত্বরেই কাঁদতে কাঁদতে সংজ্ঞা হারান মৃতার এক দাদা। আশপাশে থাকা মানুষজন তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যান এবং চোখেমুখে জল ছিটিয়ে সুস্থ করেন। জ্ঞান ফিরতেই ফের চিৎকার করে ওঠেন ওই যুবক। বলতে থাকেন, ‘‘কার কাছে বিচার চাইব?’’ মৃতার আর এক দাদাও হতাশ, ‘‘এ রাজ্যে ধর্ষণের সাজা নেই। গত দশ বছরে হাড়ে হাড়ে বুঝেছি আমরা।’’
চার অভিযুক্ত জেল থেকে মুক্ত হওয়ায় ভেঙে পড়েছেন টুম্পা এবং মৌসুমিও। এ দিন হাই কোর্ট চত্বরে তাঁরা বলেন, ‘‘দশ বছরের লড়াই শেষে এই বিচার পেলাম?’’ মৌসুমি এবং টুম্পা মৃতা তরুণীর বন্ধু ছিলেন। কামদুনিতে মুখ্যমন্ত্রী যাওয়ার পরে সেখানে বিবাদে জড়িয়েছিলেন টুম্পা। শুক্রবার প্রায় মাটিতে লুটিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দু’জনেই বলছিলেন, ‘‘কোন রাজ্যে আছি! বন্ধুর ওই অবস্থায় বুকের পাঁজর ভেঙে গিয়েছিল। আজ তার থেকেও বড় ধাক্কা খেলাম।’’
ক্ষোভের আবহে রাজনৈতিক দলগুলিও মাঠে নামছে। দলের মহিলা মোর্চা আন্দোলনে নামবে জানিয়ে বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, "দোষীরা তৃণমূল করে বলে পুলিশ বাঁচিয়েছে। আমরাও সুপ্রিম কোর্টে যাব।" সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের কথায়, "নবান্ন, স্বরাষ্ট্র দফতরের মাথা অপরাধীদের আড়াল করলে এমনই হবে। আনিস খানের ঘটনাতেও মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন। বিচার মেলেনি।"
তৃণমূল দোষীদের সঙ্গে সংস্রবের অভিযোগ উড়িয়ে পুরোটাই আদালতের বিষয় বলে ব্যাখ্যা করছে। সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেন, "ঠিক তদন্তের জোরেই সব কিছু এত দূর এগিয়েছে। একই তথ্যপ্রমাণে যাবজ্জীবন সাজা বা মৃত্যুদণ্ড হয়। তবে কী হবে সেটা বিচারপতি ঠিক করবেন।"
মৃতার পরিবার কিংবা আমজনতার একটাই কথা, ফাঁসির বদলে আমৃত্যু কারাদণ্ড মানা গেলেও ফাঁসির সাজা হওয়া এক ব্যক্তির সাজা কমে ৭ বছর হওয়াটা ‘অভাবনীয়’! বাকি তিন জনেরই বা কেন যাবজ্জীবন মকুব হল?
মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র দীর্ঘ দিনের ঘোষিত মৃত্যুদণ্ড বিরোধী। তিনিও এ দিন বলেন, ‘‘দেখা যাচ্ছে, এ দেশে আজও ন্যায় বিচারের সর্বজনীন মাপকাঠি নেই। নির্ভয়া কাণ্ড, বিলকিস বানো মামলা বা কামদুনি-কাণ্ডে অপরাধীরা আলাদা ব্যবহার পান। কখনও ফাঁসি হয়, কখনও ১৪ বছর জেল খেটেই কেউ ছাড়া পান, কারও কারও সাজার মেয়াদ কমে হয় ৭ বছর। বিচারকের দৃষ্টিভঙ্গির আপেক্ষিকতা থেকে রাজনৈতিক চাপ, নানা বিষয় একটি রায় নির্ণয় করে।’’
মৃতার পরিবারের দুই আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এবং শীর্ষেন্দু সিংহরায়ও বলেন, ‘‘নির্ভয়া-কাণ্ডের কয়েক মাসের মধ্যে এই ঘটনা ঘটেছিল। নির্ভয়া ন্যায় বিচার পেল, কামদুনির মেয়েটা পেল না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy