মা-বাবার ঝগড়া আর আইনি জটিলতায় ঘরে ফেরা আটকে গিয়েছে মাস দশেকের এই মিশরীয় শিশু অ্যাডাম হোসেনের। (নীচে) মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া সেই তিন দিনের ভিসার প্রতিলিপি।— নিজস্ব চিত্র
তিন দিনের ভিসা জোগাড় করে মায়ের কাছে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছিল তাকে। এমনিতে মিশরের নাগরিক সে। কিন্তু বাবা-মায়ের মধ্যে অশান্তি আর তার জেরে আইনি জাঁতাকলে পড়ে ফেরা হয়নি তার। মাত্র দশ মাসের একরত্তি শিশুর কলকাতায় থাকাটা এখন বেআইনি হয়ে গিয়েছে।
শিশুটির নাম অ্যাডাম হোসেন। অ্যাডামের বাবা হোসেন মহম্মদ ফাঙ্গরি আব্বাস মিশরের নাগরিক। কাজের সূত্রে কুয়েতে থাকেন। কাজের সূত্রেই বছর কয়েক আগে দুবাইয়ে গিয়েছিলেন। সেই সময় তালতলার বাসিন্দা সাবরিনা দুবাইয়ে বেড়াতে যান। সেখানে দু’জনের আলাপ এবং শেষমেশ ২০১৩-তে বিয়ে। হোসেন ও সাবরিনা বিয়ের পর কুয়েতে সংসার পেতেছিলেন। সেখানেই গত অক্টোবরে জন্ম হয় অ্যাডামের। পরে স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না-হওয়ায় সাবরিনা এ বছর এপ্রিলে কলকাতায় চলে আসেন। তবে খাতায়-কলমে তাঁদের বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়নি বলে হোসেনের দাবি।
কলকাতা শিশু কল্যাণ সমিতি সূত্রের খবর, অ্যাডাম গত ২৪ জুন তার বাবার কোলে চড়ে কলকাতায় মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। ভিসার মেয়াদ অনুযায়ী ২৬ জুনের পর আর অ্যাডামের এ দেশে থাকতে পারার কথা নয়। কিন্তু ইতিমধ্যে তার বাবার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করেছেন অ্যাডামের মা। সাবরিনার অভিযোগ, হোসেন তাঁকে মারধর করেছেন। হোসেনকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। বর্তমানে তিনি জামিনে মুক্ত। বন্ধুর বাড়িতে রয়েছেন। কিন্তু বিচারাধীন হওয়ায় কুয়েতে ফিরতে পারছেন না। হোসেনের ভিসার মেয়াদ এখনও ফুরোয়নি। ফুরিয়েছে অ্যাডামেরই। ফলে আইনি গেরোয় জড়িয়ে গিয়েছে দশ মাসের একরত্তি শিশুর ভাগ্যই।
অ্যাডামের বাবার পাসপোর্ট এখন পুলিশের কাছে। অ্যাডামের ভিসার আবেদনকারী তিনিই ছিলেন। কিন্তু নিজের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা চলায় শিশুপুত্রের ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন তিনি করতে পারছেন না। অ্যাডামের বাবা আপাতত ভারতে মিশরীয় দূতাবাসকে সব কিছু জানিয়ে তাঁর ছেলেকে নিয়ে ফিরে যাওয়ার আবেদন করেছেন। অ্যাডামের মা সাবরিনার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ ব্যাপারে কোনও কথা বলতে চাননি।
পুলিশ বাবাকে গ্রেফতার করার পরে শিশুটিকে হাওড়া শিশু কল্যাণ সমিতির কাছে দিয়েছিল। শিশু কল্যাণ সমিতি অ্যাডামকে তুলে দিয়েছে তার মায়ের হাতে। কিন্তু যে শিশুর ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে, সে এ ভাবে কত দিন থাকতে পারবে? বিষয়টি কলকাতার শিশু কল্যাণ সমিতির গোচরে আসার পর তারা কেন্দ্রীয় নারী, শিশু ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রককে বিষয়টি জানিয়ে আইনি পরামর্শ চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রশ্ন হল, অ্যাডামের বাবার ভিসার মেয়াদ ফুরোতে যখন বহু দিন বাকি, তখন তাঁর শিশুপুত্রকে মাত্র তিন দিনের ভিসা দেওয়া হয়েছিল কেন? হোসেন জানাচ্ছেন, ২০১৫-র অক্টোবরে জন্মানোর কিছু দিনের মধ্যেই অ্যাডাম মায়ের সঙ্গে কলকাতায় ঘুরে গিয়েছিল। তখন সে ছ’মাসের ভিসা পেয়েছিল। হোসেনের বক্তব্য, ‘‘আমার স্ত্রী সব ছেড়েছুড়ে চলে আসার পর জুন মাসে আমাকে ই-মেল করে জানান, তিনি অ্যাডামকে দেখতে চান। কিন্তু এক বছরের মধ্যে আরও একবার বেশি দিনের ভিসা অ্যাডামের জন্য পাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই তিন দিনের ‘ল্যান্ডিং অ্যান্ড স্টেয়িং ভিসা’ দেওয়া হয়েছিল।’’ পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হোসেন জানান, কর্মসূত্রে তাঁকে বিভিন্ন দেশে ঘুরতে হয়, তাই বেশি দিনের ভিসা পেতে তাঁর নিজের অসুবিধে হয়নি।
কিন্তু এখন অ্যাডামের কী হবে?
কলকাতা শিশু কল্যাণ সমিতির সদস্য অমিত ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট অনুযায়ী, ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত বাবার হাতে আমরা শিশুটিকে তুলে দিতে পারি না। মানবিকতার খাতিরে তাকে মায়ের কাছে থাকতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাচ্চাটি বিদেশি। আমরা কোনও ঝুঁকি না নিয়ে মন্ত্রকের কাছে পরামর্শ চেয়ে চিঠি পাঠাচ্ছি।’’ বিদেশ সম্পর্কিত বিষয়গুলির দেখভালের দায়িত্বে থাকা রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘এই অবস্থায় শিশুটির বাবা আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন। যাতে শিশুটির বসবাস বেআইনি বলে গণ্য না হয়, সেই ব্যবস্থা করতে। কারণ শিশুপুত্রের হয়ে তিনিই ভিসার আবেদন করেছিলেন।’’
এ রাজ্যের নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতর ঘটনাটি সম্পর্কে এখনও কিছু জানে না। দফতরের এক শীর্ষ আধিকারিক বলেন, ‘‘বিদেশি শিশুদের ক্ষেত্রে অনেক সময়েই সমিতি সরাসরি কেন্দ্রীয় মন্ত্রককে জানায়। বোধহয় সেই জন্যই আমরা এখনও কিছু জানি না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy