(বাঁ দিক থেকে) প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী, সাগরদিঘির বিধায়ক বাইরন বিশ্বাস এবং তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। — ফাইল চিত্র।
দেখা হলে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর পা ছুঁয়ে প্রণাম করবেন তিনি। তবে এখন থেকে চলতে চান তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখানো পথেই। বলছেন কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে সদ্য যোগ দেওয়া সাগরদিঘির বিধায়ক বাইরন বিশ্বাস।
গত মে মাসেই রাজ্য রাজনীতিতে চমক দিয়েছিলেন বাইরন। তৃণমূলের ‘গড়’ বলে পরিচিত সাগরদিঘিতে প্রায় ২৩ হাজার ভোটে বিধানসভা উপনির্বাচন জিতেছিলেন বাম-কংগ্রেসের জোটপ্রার্থী। রাজ্য বিধানসভায় তিনিই ছিলেন কংগ্রেসের একমাত্র বিধায়ক। তিনি আরও একটি চমক দিয়েছেন গত সোমবার। বিধানসভায় ‘হাত’ শিবিরকে আবার শূন্য করে দিয়ে তিনি যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। তার পর ৪৮ ঘণ্টা কেটে গেলেও বাইরনের দলবদল কেন্দ্র করে ক্রমাগত আন্দোলিত হচ্ছে বঙ্গ রাজনীতি।
তাঁর কবিতাপ্রেমী ঠাকুমা রোম্যান্টিক যুগের ব্রিটিশ কবি লর্ড বায়রনের নামে নাম রেখেছিলেন নাতির। রোম্যান্টিকতার প্রতি ঝোঁক রয়েছে বাইরনেরও। ভালবাসেন দামি সুগন্ধি। দিনে বার বার দামি চায়ে চুমুক দিতে পছন্দ করেন। পছন্দ করেন ‘বুগাত্তি’র মতো নামীদামি ব্র্যান্ডের গাড়ি। অবিবাহিত অবস্থায় কিছু প্রেমের প্রস্তাবও পেয়েছিলেন। তবে বাবার ভয়ে সে সবে ইতি টানতে হয়েছিল। বাইরনের বাবা বাবর আলি বিড়ি ব্যবসায়ী। মা সাইদা বিবি সামলান সংসার। কম বয়স থেকেই ব্যবসায় হাতেখড়ি বাইরনের। এখন ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর ব্যবসার সাম্রাজ্য। বিড়ি, চা, রাসায়নিক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মতো একাধিক ব্যবসা রয়েছে বাইরনের। ধুলিয়ানের বাসিন্দা বাইরনের সম্পর্কে জনপ্রিয় ধারণা হল, যাতেই হাত দেন তাতেই সোনা ফলান। বাইরনের স্ত্রীর নাম সুরাইয়া খাতুন। তাঁদের এক ছেলে এবং এক মেয়ে। পরিবারে তাঁরা ছাড়াও রয়েছেন বাইরনের আরও দুই ভাই এবং এক বোন।
দ্রুত সফল ব্যবসায়ী হয়ে-ওঠা বাইরন তার পরে আসেন রাজনীতিতে। সেই ‘রাজনীতিক’ বাইরনকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসাবে চিহ্নিত করেছে কংগ্রেস এবং বামশিবির। বাইরনের প্রতি প্রকাশ্যেই খড়্গহস্ত তাঁকে রাজনীতির আঙিনায় তুলে আনা অধীর। বাইরনের দলবদল নিয়ে টুইট করেছেন কংগ্রেসের শীর্ষনেতা জয়রাম রমেশ। কিন্তু তিনি, বাইরন নিজে কী মনে করছেন?
বুধবার আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে প্রশ্ন করা হয়েছিল বাইরনকে। তাঁর জবাব, ‘‘মানুষের চাহিদা পূরণে কংগ্রেস কিছু করতে পারছিল না। কংগ্রেসে থেকে মানুষের জন্য কোনও কাজ করতে পারতাম না। তৃণমূলে না গেলে মানুষের কাজ করব কী ভাবে? তবে কংগ্রেসের প্রতি আমি অবশ্যই কৃতজ্ঞ। আমি ব্যক্তিস্বার্থে দল ছাড়িনি। তা হলে আমাকে কেন ‘গদ্দার’ বলবে?’’ অধীরের প্রসঙ্গ উঠতে সাগরদিঘির বিধায়কের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘ওঁকে কেন এড়িয়ে যাব? আমি কি চুরি করেছি?’’ সামান্য বিরতির পর বাইরনের সংযোজন, ‘‘অধীর চৌধুরী প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। অবশ্যই তাঁকে সম্মান দেব। দেখা হলে তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করব।’’
দলবদলের ঘটনায় বার বারই একই প্রশ্ন ওঠে যে, এক দলের হয়ে ভোটে জিতে পরে অন্য দলে যোগ দেওয়া কতটা ‘নৈতিক’। বাইরনের ক্ষেত্রেও উঠেছে। অনেকেই বলছেন, কংগ্রেসের বিধায়ক পদ ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়ে জোড়াফুল প্রতীকে আবার ভোটে দাঁড়াতে পারতেন বাইরন। তবে সাগরদিঘির বিধায়ক তার কোনও প্রয়োজন দেখছেন না। তাঁর যুক্তি, ‘‘তিন মাস আগেই মানুষের রায় নিয়েছি। মানুষ ব্যক্তি বাইরন বিশ্বাসকে ভোট দিয়েছেন। তাই নতুন করে নির্বাচনের কোনও প্রয়োজন নেই।’’
বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ বুধবারেই দাবি করেছেন, বাইরন একটা সময়ে বিজেপি করতে চেয়েছিলেন। দিলীপ বলেছেন, ‘‘আমি ওকে চিনি। ও একসময় বিজেপি করতে চেয়েছিল। আমিই বারণ করেছিলাম। বলেছিলাম, তুমি ব্যবসায়ী বাড়ির ছেলে। বিজেপি করলে তোমার ব্যবসা করতে অসুবিধা হবে। তুমি যে হেতু সংখ্যালঘু, তোমাকে স্বীকৃতি দেবে না।’’ এটা কি সত্যি? আনন্দবাজার অনলাইনের এই প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছেন সদ্য তৃণমূলে যোগ দেওয়া বিধায়ক।
গত সোমবার তৃণমূলের ‘নবজোয়ার যাত্রা’র মধ্যেই পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালে অভিষেকের হাত ধরে তৃণমূলের যোগ দেন বাইরন। এ নিয়ে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনও মন্তব্য করতে না চাইলেও অভিষেক বাইরনকে পাশে বসিয়ে বার্তা দিয়েছিলেন, বাইরন মুর্শিদাবাদে বিজেপি বিরোধী কণ্ঠস্বর হয়ে উঠবেন। বাইরনও জানিয়েছেন, মমতার সঙ্গে তাঁর কোনও কথা হয়নি। এই বিধায়কের কথায়, ‘‘দিদির সঙ্গে আমার কথা হয়নি। অভিষেকদাকে খুব ভাল লেগেছে। অভিষেকদা আমাকে সম্মান দিয়েছেন। মর্যাদা দিয়েছেন।’’ পাশাপাশিই তিনি বলেছেন, ‘‘দিদি আমাদের সর্বভারতীয় নেত্রী। অভিষেকদা আমাদের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। যে হেতু অভিষেকদার হাত ধরে যোগদান, তাই তাঁকেই অনুসরণ করব। তবে দিদির আদেশ সব সময়েই শিরোধার্য।’’
মাস তিনেক আগের উপনির্বাচনে কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে প্রচারে নেমে ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বাইরন। তার ফলও পেয়েছিলেন ভোটে। প্রায় ২৩ হাজার ভোটে জিতেছিলেন তিনি। সেই প্রত্যাশা পূরণের চাপেই কি দলবদল? বাইরনের জবাব, ‘‘মানুষের জন্য অনেক কাজ করতে চাই। কংগ্রেসের সে ক্ষমতা নেই। সদিচ্ছাও নেই। তাই তৃণমূলে মানুষের কাজ করতে এসেছি। কোথা থেকে করব, কী ভাবে করব সেটা আমার ব্যাপার। কিন্তু মানুষকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আমাকে পূরণ করতেই হবে।’’ উপনির্বাচনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। এখন দলবদলের তাঁর অভিমত কী? বাইরন বলছেন, ‘‘কে কী করল তা আমার দেখার দরকার নেই। সরকারের সাহায্য নিয়ে স্বচ্ছ ভাবে মানুষের কাছে কাজ পৌঁছে দেওয়াই আমার লক্ষ্য।’’
কংগ্রেসের অভিযোগ, উপনির্বাচনের সময় তাদের কর্মীরা মার খেয়েছে তৃণমূলের কাছে। দলবদলের পর কি তাঁদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী বাইরন? সাগরদিঘির বিধায়ক বলছেন, ‘‘এ সব প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, মানুষ রাজনৈতিক মতাদর্শ পরিবর্তন করতেই পারে।’’ প্রসঙ্গত, কিছু দিন আগে এক তৃণমূল নেতার সঙ্গে বাইরনের কথোপকথনের একটি ‘অডিয়ো রেকর্ডিং’ ভাইরাল হয়ে যায়। যেখানে ওই তৃণমূল নেতাকে কড়াভাষায় গালিগালাজ করার অভিযোগ ওঠে বাইরনের বিরুদ্ধে। সেই কণ্ঠস্বর যে তাঁরই, তা স্বীকার করে নিয়েছেন সাগরদিঘির বিধায়ক। তবে পাশাপাশিই বললেন, ‘‘আরও বেশি বলা উচিত ছিল! কারণ, ও (সংশ্লিষ্ট তৃণমূল নেতা) যা বলেছে, তা আমি প্রকাশ্য আনিনি। ওঁকে ক্ষমা করার প্রশ্নই ওঠে না। তৃণমূলে এসেছি বলে কি মানসম্মান বিক্রি করে দিয়েছি!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy