বাবা তোফিদ শেখ। —নিজস্ব চিত্র।
সদ্য আঠারো পেরিয়ে উনিশে পা দিয়েছিলেন বড় ছেলে। সংসারের অভাব ঘোচাতে তাঁকে সঙ্গে করে মিজ়োরামে নিয়ে গিয়েছিলেন বৃদ্ধ বাবা। আর ফিরলেন সেই ছেলেরই লাশ কাঁধে নিয়ে! সেতু বিপর্যয়ের তিন দিন পর শনিবার শাহিন আখতারের দেহ বাড়িতে ফিরতেই কান্নার শব্দে ভারী হয়ে উঠেছিল মালদহের চৌদুয়ার গ্রামের বাতাস। ছেলের দেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে এসেই হাঁটু মুড়ে বসে পড়েন বাবা তোফিদ শেখ। কাঁদতে কাঁদতে তাঁর গলা ভেঙে গিয়েছে। ভাঙা গলাতেই নাচার বৃদ্ধের আর্তনাদ, ‘‘চোখের সামনে মরে গেল ছেলেটা। কিচ্ছু করতে পারলাম না!’’
কিছু দিন আগেই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছিলেন শাহিন। ভাল নম্বরও পেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন নার্সের প্রশিক্ষণ নিতে। কিন্তু তার জন্য কিছু টাকার দরকার ছিল। তোফিদেরও সামর্থ্য ছিল না ছেলের পড়াশোনার টাকা জুগিয়ে যাওয়ার। এই পরিস্থিতিতে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাতে আর সংসারে কিছুটা সাহায্য করতেই বাবার সঙ্গে মিজ়োরামের আইজলে পাড়ি দিয়েছিলেন শাহিন। সেখানে নির্মীয়মাণ রেলসেতু ভেঙে তাঁর মৃত্যু হয়। কফিনবন্দি ছেলের পাশে বসেই তোফিদ বলেন, ‘‘আরও পড়াশোনা করতে চেয়েছিল ও। আমার অত ক্ষমতা ছিল না বলে নিজেই চেয়েছিল যেতে। আমিও নিয়ে গেলাম। কেন যে নিয়ে গেলাম! আমার সব শেষ হয়ে গেল।’’
ভিন্রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করেই এতকাল সংসার টেনেছেন তোফিদ। এখন তাঁর বয়স হয়েছে। পরিবার সূত্রে খবর, এ বার শাহিনও বাবার সঙ্গে কাজে যেতে চেয়েছিলেন। সংসারের কথা ভেবে বাড়তি রোজগারের আশায় তোফিদও তাঁকে মিজ়োরামে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাবা তোফিদ জানান, তিনি রেলসেতুর নীচে কাজ করতেন। শাহিন কাজ করতেন সেতুর উপরে। বুধবার সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ চোখের সামনে সেই সেতু ভেঙেই ছেলেকে উপর থেকে পড়ে যেতে দেখেছেন তিনি। কাঁপা গলায় বৃদ্ধ বলতে থাকেন, ‘‘নিজের চোখে ছেলেটাকে উপর থেকে পড়ে যেতে দেখলাম। এখনও চোখের সামনে ভাসছে ওই দৃশ্যটা!’’
শুধু চৌদুয়াতেই নয়, একই দৃশ্য দেখা গিয়েছে ইংরেজবাজারের সাট্টারি, কোকলামির, গাজলের কালিয়াবাদ, কালিয়াচকের পঞ্চানন্দপুরের লস্করিটোলা গ্রামেও। মিজ়োরামে মালদহেরই ২৩ জন পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে। রেল সূত্রও জানিয়েছে, ঘটনার দিন ১৮ জনের দেহ শনাক্ত হয়েছিল। মিজ়োরাম থেকে সেই সব শ্রমিকদের দেহ এখন মালদহের গ্রামে-গ্রামে ফিরছে। জেলাবাসীর দাবি, ভিন্রাজ্যে কাজে গিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু মালদহে নতুন ঘটনা নয়। কখনও বহুতল ভেঙে, কখনও নির্মীয়মাণ সেতু কিংবা পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন বহু পরিযায়ী শ্রমিক। সম্প্রতি করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় জেলার একাধিক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তা-ও কেন ভিন্রাজ্যে ছুটছেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা, সে প্রশ্নই ফের উঠেছে মিজ়োরামের ঘটনার পরে। মৃত পরিযায়ী শ্রমিক সেনাউল হকের (৪৮) স্ত্রী মিলি বিবি বলেন, “ভিন্রাজ্যে কাজে গিয়ে দুর্ঘটনায় বড় ছেলের কোমর ভেঙে যায়। সে কাজ করতে পারে না। তার দুই ছেলেমেয়ে রয়েছে। আমাদের তিন ছেলেমেয়ে আছে।” ভিন্রাজ্যে কাজে না গেলে আটটা পেট চলবে কী ভাবে, প্রশ্ন করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, “নিজেদের কোনও জমি নেই। গ্রামে কাজও নেই। তাই ঝুঁকি নিয়ে কাজের জন্য স্বামীকে ভিন্রাজ্যে যেতে হয়েছে।”
মিজ়োরামে দুর্ঘটনা থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন চৌদুয়ারের বাসিন্দা রেফাজুদ্দিন শেখ। তিনি বলেন, “চাঁদে অভিযান নিয়ে অনেকে মাতামাতি করছে। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দু’বেলা রুটি-রুজির কথা কেউ ভাবছেন না।” এ ব্যাপারে মালদহের জেলাশাসক নিতিন সিংহানিয়া বলেন, “প্লাস্টিক, কার্পেট ক্লাস্টার জেলায় তৈরি হচ্ছে। পরিযায়ী শ্রমিকেরা যাতে জেলায় কাজ করতে পারেন, সে জন্য ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে পাঁচ লক্ষ টাকার ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া, রাজ্য সরকারের একাধিক প্রকল্পে পরিযায়ী শ্রমিকদের যুক্ত করার কাজও চলছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy