Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪
নিশানায় নেতা

হুড়মুড়িয়ে ঢুকে গুলি চালিয়ে দিল ছেলেগুলো

অন্য দিনের মতোই বগুলা শ্রীকৃষ্ণ কলেজের সামনে দোকান ঘরে খোলা নিজের দলীয় কার্যালয়ে এসেছেন তিনি। রোজই তাঁর আসার আগে এসে ভিড় জমান ঘনিষ্ঠেরা। সে দিন সেই ভিড়টা নেই। কেমন যেন ফাঁকা-ফাঁকা। 

দুলাল বিশ্বাস। ডান দিকে, খুনের পরে তাঁর কার্যালয়। নিজস্ব চিত্র

দুলাল বিশ্বাস। ডান দিকে, খুনের পরে তাঁর কার্যালয়। নিজস্ব চিত্র

সুস্মিত হালদার
হাঁসখালি শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:৩৬
Share: Save:

রাত প্রায় আটটা।

অন্য দিনের মতোই বগুলা শ্রীকৃষ্ণ কলেজের সামনে দোকান ঘরে খোলা নিজের দলীয় কার্যালয়ে এসেছেন তিনি। রোজই তাঁর আসার আগে এসে ভিড় জমান ঘনিষ্ঠেরা। সে দিন সেই ভিড়টা নেই। কেমন যেন ফাঁকা-ফাঁকা।

দুরে দাঁড়িয়ে গল্প করছে তাঁর ছেলে আর গাড়ির চালক। রাস্তার দিকে মুখ করে রিভলভিং চেয়ারে বসে উপস্থিত কর্মীদের সঙ্গে টুকটাক কথা বলছেন হাঁসখালি ব্লকের দোর্দান্ডপ্রতাপ নেতা দুলাল বিশ্বাস। আচমকা জনা পাঁচেক যুবক হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে ভিতরে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলি ছিটকে আসে— ফট ফট ফট... রক্ত ছিটকে ওঠে। লুটিয়ে পড়েন দুলাল।

এতই আকস্মিক এই হামলা, ঘরে উপস্থিত কেউ প্রায় নড়তেই পারেননি। সেই সুযোগে পাশের গলি দিয়ে রেলের ঝুপড়ির পাশ দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় আততায়ীরা। যাওয়ার আদে দুটো আগ্নেয়াস্ত্র ফেলে রেখে যায় রাস্তায়। রক্তাক্ত দুলালকে পাশেই বগুলা গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা জানান, আর কিছু করার নেই।

২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল।

ওই রাতেই দুলালের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, কংগ্রসে থেকে তৃণমূলে আসা প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধান বিমল বিশ্বাস-সহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন দুলালের ছেলে বাপ্পা বিশ্বাস। পুলিশ প্রথমেই দুলালের গ্রাম ভায়নার বাসিন্দা কার্তিক বিশ্বাস ও তার ছেলে বিশ্বজিৎ বিশ্বাসকে গ্রেফতার করে। দু’জনই এলাকায় তৃণমূল কর্মী বলে পরিচিত ছিল। পরে তদন্তভার নেয় সিআইডি। একে একে গ্রেফতার হয় ন’জন। তার মধ্যে বিমল বিশ্বাস ছাড়াও ছিল ভৈরবচন্দ্রপুরের সুকুমার বিশ্বাস, ২০১৪ সালে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে যার দাদা খুন হয়েছিলেন।

হাঁসখালির অনেকেই কিন্তু এখনও বিশ্বাস করেন, সিআইডি প্রকৃত খুনিদের গ্রেফতার করেনি। কেননা গোটা গল্পের মধ্যেই ছড়ানো খুন আর বদলা-খুনের ইতিহাস।

২০০৪ সালে ভরসন্ধ্যায় খুন হয়েছিলেন দুলালের ভাই স্বপন বিশ্বাস। দুলাল তখন সিপিএমের দাপুটে নেতা। খুনের মামলায় নাম ছিল তৎকালীন কংগ্রেস নেতা শশাঙ্ক বিশ্বাস, বিমল বিশ্বাসদের। গ্রেফতারও হয়েছিলেন তাঁরা। বছরখানেক পরে ভায়না বাজারে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হন তিন কংগ্রেস কর্মী। অভিযোগ ওঠে, ভাইয়ের খুনের বদলা নিতে দুলালই ওই তিন জনকে খুন করিয়েছেন। গ্রেফতার হন তিনিও। এর দু’বছর বাদে শশাঙ্করা জামিন পেয়ে তৃণমূলে যোগ দেন। কেউ-কেউ তৃণমূলে গিয়ে পঞ্চায়েতের প্রধান এবং উপপ্রধানও হয়েছেন। বগুলা এলাকায় তৃণমূলের সর্বময় কর্তা হয়ে ওঠেন তাঁরাই।

দুলাল জামিনে ছাড়া পান ২০০৯ সালে। তার পরেও তাঁর দাপট কমেনি। ২০১১-র বিধানসভা ভোটের পরে পুলিশ তাকে গাঁজা পাচার মামলায় গ্রেফতার করে। পরের বছর ফের জামিনে ছাড়া পেয়ে তিনি রানাঘাট (উত্তর-পূর্ব) কেন্দ্রের বিধায়ক সমীর পোদ্দারের হস্তক্ষেপে তৃণমূলে যোগ দেন এবং জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্তর একান্ত অনুগামী হয়ে ওঠেন। কার্যত গৌরীশঙ্করের বদান্যতাতেই ২০১৩ সালে বিমল বিশ্বাসকে হটিয়ে বগুলা-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান হন তিনি। ২০১৫ সালে দলের অন্দরে চরম বিরোধিতা সত্ত্বেও গৌরীশঙ্কর তাঁকে হাঁসখালি ব্লক সভাপতি করেন।

বস্তুত দুলাল তৃণমূলে ঢোকার পর থেকেই কংগ্রেস থেকে আসা নেতা এবং আদি তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে ভিতরে-ভিতরে তাঁর বিবাদ বেধেছিল। ব্লক সভাপতি হয়ে দলের ভিতরের বিরোধীদের একেবারে কোণঠাসা করে ফেলেছিলেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, গোটা এলাকাও বিরোধীশূন্য করে ফেলেন। এই একচ্ছত্র আধিপত্যই হয়তো তাঁর কাল হয়েছিল।

হতাশ বাপ্পা বলেন, “আমরা সুবিচার পেলাম না। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে এক জন বাদে সকলেই জামিন পেয়ে গিয়েছে। সিআইডি-র তদন্তও মাঝপথে থমকে গেল।”

দুলালের একদা অনুগামীরা এখনও মনে করেন, এই খুনের পিছনে রয়ে গিয়েছে গভীর রহস্য, যা হয়তো কোনও দিনই সামনে আসবে না।

অন্য বিষয়গুলি:

Dulal Biswas Murder Nadia TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy