Advertisement
E-Paper

মাসের পর মাস বিধানসভার অধিবেশনে গরহাজির মন্ত্রী মনোজ তিওয়ারি! কেন তিনি নেই, জানে না পরিষদীয় দল

সদ্যসমাপ্ত বাজেট অধিবেশনের জোড়া পর্ব তো বটেই, গত বছর শীতকালীন অধিবেশনেও যোগদান করেননি শিবপুরের বিধায়ক তথা রাজ্যের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মনোজ তিওয়ারি।

শিবপুরের বিধায়ক তথা রাজ্যের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মনোজ তিওয়ারি।

শিবপুরের বিধায়ক তথা রাজ্যের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মনোজ তিওয়ারি। —ফাইল চিত্র।

অমিত রায়

শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২৫ ১২:০৬
Share
Save

সম্প্রতি বিধানসভার বাজেট অধিবেশনে বিধায়কদের একাংশ দলীয় ‘হুইপ’ অমান্য করায় কড়া পদক্ষেপ করতে চলেছে তৃণমূল পরিষদীয় দল। কিন্তু হুইপ অমান্যকারী বিধায়কদের তালিকা তৈরি করতে গিয়ে রাজ্যের এক মন্ত্রীর অনুপস্থিতির বহর দেখে কার্যত স্তম্ভিত তৃণমূল পরিষদীয় দল। সদ্যসমাপ্ত বাজেট অধিবেশনের জোড়া পর্ব তো বটেই, গত বছর শীতকালীন অধিবেশনেও যোগ দেননি শিবপুরের বিধায়ক তথা রাজ্যের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মনোজ তিওয়ারি। বস্তুত, শেষ কবে এই প্রাক্তন ক্রিকেটারকে বিধানসভায় দেখা গিয়েছে, তা মনেও করতে পারছেন না সতীর্থ বিধায়কেরা।

মনোজের এ-হেন আচরণে ‘ক্ষুব্ধ’ তৃণমূল পরিষদীয় দলের একাংশ। সাধারণত শাসক বা বিরোধীদলের কোনও বিধায়ক বিধানসভার অধিবেশন বা কোনও কমিটির বৈঠকে হাজির হতে না-পারলে স্পিকারকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়ে দেন। কিন্তু বিধানসভার সচিবালয় সূত্রে খবর, মনোজের তরফে তেমন কিছু করা হয়নি।

সেই সূত্রেই প্রশ্ন উঠেছে, মনোজ কি আর মন্ত্রী থাকতে চান না? বস্তুত, অনেকে এমন প্রশ্নও তুলছেন যে, মনোজ কি আদৌ রাজনীতিতে থাকতে চান? মন্ত্রিত্ব, রাজনীতিতে থাকতে চান না বলেই তিনি তিনি এ ভাবে মাসের পর মাস বিধানসভার অধিবেশনে অনুপস্থিত থেকে দল এবং সরকারের কাছে ‘বার্তা’ পাঠাতে চাইছেন? তাঁর অনুপস্থিতির কারণ জানতে মনোজকে তাঁর ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর-সহ ফেসটাইম এবং হোয়াট্‌সঅ্যাপে একাধিক বার ফোন করা হলেও জবাব মেলেনি। জবাব আসেনি তাঁকে মোবাইলে পাঠানো হোয়াট্‌সঅ্যাপ এবং টেক্সট মেসেজেরও। মনোজের তরফে কোনও জবাব এলে তা এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হবে। মনোজের অনুপস্থিতি নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে চাননি তৃণমূলের কোনও বিধায়কও।

সাম্প্রতিক কালে হাওড়ার রাজনীতিতে মনোজ কয়েক বার বিতর্কে জড়িয়েছেন। তাঁর সঙ্গে বিবাদ বেধেছে হাওড়া পুরসভার প্রশাসক সুজয় চক্রবর্তী এবং বর্ষীয়ান তৃণমূল নেতা তথা মন্ত্রী অরূপ রায়ের। শিবপুরে একটি মেলায় পার্কিং নিয়ে মনোজ-সুজয়ের মধ‍্যে গোলমাল হয়েছিল। দু’পক্ষ ধস্তাধস্তিতেও জড়িয়ে পড়েছিল। বিবাদ মেটাতে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে যেতে হয়েছিল শিবপুরে। ওই ঘটনার উৎস মনোজ-অরূপের (রায়) দীর্ঘ দিনের ‘দ্বন্দ্ব’ বলেই মনে করেন তৃণমূলের অনেকে। বস্তুত, শিবপুর বিধানসভা এলাকায় অরূপ-মনোজ বিবাদ সর্বজনবিদিত। ২০২১ সালে মনোজ বিধায়ক হওয়ার পর থেকে বিবাদের সূত্রপাত। হাওড়া জেলার রাজনীতিতে তৃণমূলের ‘প্রবীণ মুখ’ অরূপ। তাঁর হাত ধরেই তৃণমূলের হাওড়ায় প্রবেশ। তাই অরূপের বিচরণ হাওড়া সদর জেলার সর্বত্র। কিন্তু মনোজ আবার নিজের বিধানসভা কেন্দ্রে কারও ‘হস্তক্ষেপ’ বরদাস্ত করেন না। রাজনৈতিক এলাকা ‘দখল’ নিয়েই অরূপ-মনোজ বিবাদ শুরু হয়েছিল। তা এখনও জারি আছে। যদিও প্রকাশ্যে দু’পক্ষের কেউই অপর পক্ষকে নিয়ে কটু মন্তব্য করেন না।

মনোজের সঙ্গে গোলমাল হয়েছে হাওড়া পুরসভার প্রশাসক সুজয়েরও। শিবপুরের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার সংস্কার শুরুর পর এলাকার বিধায়ক মনোজের অনুগামীরা একটি ফ্লেক্স লাগিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, মনোজের উদ্যোগে এবং হাওড়া পুরসভার সহযোগিতায় রাস্তাটি নির্মিত হচ্ছে। কাজ শেষের পর আবার সুজয়ের পক্ষ থেকে আর একটি ফ্লেক্সে উল্লেখ করা হয়, মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় এবং সুজয়ের আন্তরিক উদ্যোগে রাস্তা নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। ওই ফ্লেক্স লাগানো নিয়ে দু’জনের বিরোধ আরও বাড়ে। ২০২৪ সালের জুন মাসে মনোজ প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন, তাঁর বিধানসভা এলাকায় উন্নয়নমূলক কাজের গতি ‘ধীর’। সুজয় তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করেন না। সুজয় সেই অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেন, শিবপুরে যথেষ্ট উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে।

রাজনীতিতে মনোজের আগমন খুব বেশি দিন আগে নয়। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে শিবপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বর্ষীয়ান বিধায়ক জটু লাহিড়ীকে সরিয়ে ক্রিকেটার মনোজকে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। টিকিট না পেয়ে বিজেপিতে চলে যান জটু। তাতে মনোজের জয় আটকায়নি। বিজেপির প্রার্থী রথীন চক্রবর্তীকে ৩২,৬০৩ ভোটে হারিয়ে জিতেছিলেন মনোজ। তিনি প্রথম বার জেতার পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনোজকে ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ দফতরের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। এর আগে ২০১৬ সালে উত্তর হাওড়া কেন্দ্র থেকে প্রাক্তন ক্রিকেটার লক্ষ্মীরতন শুক্লা তৃণমূলের টিকিটে জেতার পরে তাঁকেও ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ দফতরের প্রতিমন্ত্রী করেছিলেন মমতা। কিন্তু ২০২১ সালে লক্ষ্মীরতন ভোটে দাঁড়াতে চাননি। তাই ভোটের পরে মমতা সেই দফতরের দায়িত্ব দেন মনোজকেই। নব মহাকরণে তাঁকে দেওয়া হয়েছে একটি ঝাঁ-চকচকে দফতরও। সেখানেও মনোজ যে নিয়মিত আসেন, তা-ও নয়। প্রাক্তন ক্রিকেটার লক্ষ্মী মন্ত্রী এবং বিধায়ক হিসাবে তুলনায় ‘সপ্রতিভ’ ছিলেন বলেই মনে করে তৃণমূল পরিষদীয় দল। পরিষদীয় দলের নির্দেশ মতো বিধানসভার অধিবেশনে নিয়মিত যোগদান করতেন তিনি। দলের শীর্ষনেতাদের পরামর্শও নিয়মিত নিতেন তিনি।

বিধানসভায় এই ‘অনুপস্থিতি’ এবং দফতরে ‘অনিয়মিত উপস্থিতি’ নিয়ে অবশ্য অন্য কেউ কোনও ‘শাস্তিমূলক’ ব্যবস্থা নিতে পারবেন না। কারণ, মনোজ মন্ত্রী। তাই তাঁর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। ফলে তৃণমূল পরিষদীয় দল বা শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির পক্ষে কোনও পদক্ষেপ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে ১৯-২০ মার্চ দলের দেওয়া হুইপ অমান্য করে কেন মনোজ অধিবেশনে গরহাজির রইলেন, তা তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন তৃণমূল পরিষদীয় দলের মুখ্য সচেতক নির্মল ঘোষ। পরিষদীয় দলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, যোগাযোগের জন্য মুখ্য সচেতকের দফতরে মনোজের একটি মোবাইল নম্বর দেওয়া থাকলেও সেই নম্বরটি ক্রমাগত বেজে যায়। সেটি কেউ ধরেন না।

তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, ২০২১ সালের ভোটের আগে মনোজের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে ভোটে লড়ার জন্য রাজি করিয়েছিল প্রশান্ত কিশোরের সংস্থা আইপ্যাক। তখন মনোজ পুরোদমে বাংলার হয়ে ক্রিকেট খেলছেন। তাই তাঁর রাজনীতিতে যোগদানের শর্ত ছিল, ভোটে জিতলেও তাঁকে যেন ক্রিকেট খেলতে দেওয়া হয়। সেই শর্তেই তাঁকে শিবপুরে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। ২০২৩ সালের অগস্টে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছিলেন তিনি। যদিও ক্রিকেট মাঠে সক্রিয় থাকার সময়েও মনোজ বিধানসভার অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু অবসর নেওয়ার পরে অধিবেশনে অংশগ্রহণ প্রায় বন্ধই করে দিয়েছেন তিনি।

ঘটনাচক্রে, মনোজের মতোই ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে লড়েছিলেন বাংলা দলে তাঁর সতীর্থ অশোক ডিন্ডা। বিজেপির হয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের ময়না কেন্দ্র থেকে ভোটে দাঁড়িয়ে জিতেছিলেন প্রাক্তন ক্রিকেটার অশোক। বিধানসভার অধিবেশনে তাঁর উপস্থিতি কিন্তু চোখে পড়ার মতো। যদিও বিধানসভার কোনও বিতর্কে তিনি এখনও বক্তৃতা করেননি। কিন্তু প্রশ্নোত্তরপর্ব, উল্লেখপর্ব এবং দৃষ্টি আকর্ষণীপর্বে ময়না বিধানসভা এলাকার বিভিন্ন বিষয় এবং রাজ্যের সমস্যা নিয়ে অশোককে সরব হতে দেখা গিয়েছে। এমনকি, বিজেপি পরিষদীয় দলের অন্দরে যে ‘হল্লা ব্রিগেড’ রয়েছে, তাতেও সতীর্থদের সঙ্গে সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে অশোকের। তবে ‘বন্ধু’ মনোজের বিধানসভার অধিবেশন দীর্ঘ দিন ধরে এড়িয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চাননি প্রাক্তন মিডিয়াম পেসার অশোক।

West bengal Assembly TMC West Bengal Politics

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}