পাঁচ বছরের শবর শিশু নকুল ভুক্তার জন্ডিসের উপসর্গ রয়েছে। ওঝার কাছে নিয়ে গিয়ে কপাল চিরে তার দৈব চিকিৎসা করিয়েছেন অভিভাবকেরা। ঝাড়গ্রামের বাঘঝাঁপা গ্রামে রবিবার। ছবি: কিংশুক গুপ্ত
এক ঝলক দেখে মনে হবে কাজলের টিপ। আসলে ক্ষতচিহ্ন। জন্ডিসের দৈব চিকিৎসায় ব্লেড দিয়ে কপাল চিরে লাগানো হয়েছে শিকড় বাটা। সেই দাগই দগদগে হয়ে রয়েছে লোধা-শবর গ্রাম বাঘঝাঁপার কয়েকজন শিশু, তরুণের কপালেও।
ঝাড়গ্রাম ব্লকের আগুইবনি পঞ্চায়েতের জঙ্গলঘেরা গ্রাম বাঘঝাঁপা। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে বড়জোর ১৫ কিলোমিটার দূর। ১৩০টি পরিবারের মধ্যে ৬০টিই লোধা-শবর। সেখানেই প্রায় একমাস ধরে জন্ডিসের উপসর্গ দেখা দিয়েছে বহু শিশুর। লোধা-শবরের পাশাপাশি সাধারণ সম্প্রদায়ের শিশু-তরুণরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। আশাকর্মীরা বিষয়টি ব্লক স্বাস্থ্য দফতরের নজরে এনেছিলেন। কিন্তু গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। অভিভাবকেরাও শিশুদের ওঝার কাছে নিয়ে গিয়ে একশো টাকায় দৈব চিকিৎসা করিয়েছেন। কপাল চিরে শিকড় বাটার প্রলেপ লাগানোয় জন্ডিস সেরে যাচ্ছে বলেই তাঁদের বিশ্বাস। এক-দু’জন তাই দূরে চিকিৎসকের চেম্বারে দেখানোর পরেও ওঝার কাছে গিয়েছেন।
করোনা আবহের মধ্যে এমন ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। রবিবার ঝাড়গ্রামের ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক রণজিৎ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে মেডিক্যাল টিম গ্রামে যায়। আক্রান্তদের রক্ত পরীক্ষার জন্য লিখে দেওয়া হলেও অভিভাবকেরা জানাচ্ছেন, তাঁরা রক্ত পরীক্ষা করাতে যাবেন না। বিকেলে গ্রামে যান জেলাশাসক আয়েষা রানি ও ঝাড়গ্রামের বিডিও অভিজ্ঞা চক্রবর্তী। তাঁরা লোধা-শবর পাড়ায় বাড়ি-বাড়ি খোঁজ নেন। ফের বিকেলেও মেডিক্যাল টিম অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে গ্রামে পৌঁছয়। কিন্তু করোনার ভয়ে আক্রান্তরা হাসপাতালে যেতে চাইছেন না। জেলাশাসক বলেন, ‘‘ওই গ্রামে ফের মেডিক্যাল টিম পাঠানো হবে।’’
স্বাস্থ্য দফতর ও স্থানীয় সূত্রে খবর, গ্রামের ২৫ জনের জন্ডিসের উপসর্গ দেখা দিয়েছে। তার মধ্যে ১৫ জনই লোধা-শবর শিশু। প্রাথমিক ভাবে স্বাস্থ্য দফতরের অনুমান, নলকূপের জল থেকে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। গ্রামের সরকারি প্রকল্পের ট্যাপ রয়েছে। অনেকের বাড়িতে হ্যান্ড টিউবওয়েলও রয়েছে। তবে পানীয় জলের নমুনা পরীক্ষা করানো হয়নি।
জানা যাচ্ছে, মাস খানেক আগে গ্রামের এক শবর শিশু অসুস্থ হয়। এর পরে একের পর এক শিশুর জ্বর ও হলুদ প্রস্রাব হতে থাকে। এ দিন গ্রামে গিয়ে দেখা গেল ব্লকের স্বাস্থ্য আধিকারিক বাঘঝাঁপা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বসে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন। তিনি কথা বলতে রাজি হননি। সেখান থেকে প্রেসক্রিপশন হাতে তিন বছরের ছেলে রণজিৎকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে এলেন বাবা রতন ভুক্তা। ছেলের কপালে কাটা দাগ। রতন বলেন, ‘‘দিন সাতেক আগে ছেলের হলুদ প্রস্রাব হচ্ছিল। পাশের আঁধারিশোল গ্রামের ওঝার কাছে নিয়ে গিয়ে কপাল চিরে দৈব চিকিৎসা করিয়েছি। ছেলে এখন ভাল আছে। রক্ত পরীক্ষা করাব না।’’
আক্রান্তদের ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালের আউটডোরে দেখাতে বলেছেন ব্লকের স্বাস্থ্য আধিকারিক। জল ফুটিয়ে খেতে বলেছেন। রক্ত পরীক্ষা করাতে বলেছেন। কিন্তু সেই কাজ কতটা হবে তা সংশয় থাকছেই। গ্রামের বেলমণি মান্ডি জানালেন, তাঁর সাত বছরের ছেলে সূর্যকান্তের জ্বর ও বমি হওয়ায় চন্দ্রির এক হাতুড়েকে দেখান। তিনিও রক্ত পরীক্ষার পরামর্শ জে। কিন্তু ভয়ে করাননি। দিনমজুর দয়াল দাসের স্কুল পড়ুয়া তিন মেয়ে ও এক ছেলেও জন্ডিসে আক্রান্ত। দয়াল বলেন, ‘‘ঝাড়গ্রামে এক বেসরকারি চিকিৎসকের চেম্বারে চারজনকেই দেখিয়েছি। চিকিৎসক জন্ডিস হয়েছে বলেছেন। শেষে চারজনেরই কপাল চিরিয়ে দৈব চিকিৎসা করিয়েছি।’’
সাত বছরের দেবাশিস সিংহের রক্ত পরীক্ষা হলেও শেষমেশ ভরসা দৈব চিকিৎসাই। তাদের বাড়ির উঠোনে টিউবওয়েলের কাছে জমে রয়েছে নোংরা জল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy