বুকিং নেই। এখনও গুদামেই পড়ে রয়েছে আলোর বোর্ড। নিজস্ব চিত্র
ফোনের পর ফোন আসছে। কখনও উদ্যোক্তাদের, কখনও আবার কাজের বরাত ধরে ডেকরেটর্স সংস্থার ফোন। রাতের পর রাত জেগে চলছে কাজ। তিলে তিলে গড়ে উঠছে আকর্ষণীয় মণ্ডপ। রূপ পাচ্ছে চোখ ধাঁধানো আলোর সাজ।
অন্য বছর মহালয়ার আগে মণ্ডপ ও আলোক শিল্পীদের দম ফেলার ফুরসত মেলে না। এ বার একেবারে খরা। কোনও ব্যস্ততা নেই, নেই ঘন ঘন ফোন। দুর্গাপুজোর কাজের বরাতই যে নেই! করোনা-কালে উৎসবের মরসুম শুরু মুখে তাই চরম অনিশ্চয়তায় রয়েছেন পশ্চিম মণ্ডপ ও আলো শিল্পের সঙ্গে মেদিনীপুরের কয়েক হাজার শিল্পী, শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারগুলি। পুজোর বরাত না পেয়ে সঙ্কটে পড়েছেন ডেকরেটর্স ব্যবসায়ীরাও।
একে আর্থিক সঙ্কট, তার উপর স্বাস্থ্য বিধির কড়াকড়ি— দুর্গাপুজো আয়োজন এই করোনা পরিস্থিতিতে কী ভাবে সম্ভব সেটাই এখন প্রশ্ন। এ বার মহালয়ার এক মাসেরও বেশি পরে দুর্গাপুজো। কিন্তু এখনও পুজো নিয়ে বেশিরভাগ উদ্যোক্তাই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি। অথচ মেদিনীপুর, ঘাটাল, খড়্গপুর থেকে চন্দ্রকোনা রোড— জেলা জুড়েই বড় বাজেটের পুজো নেহাত কম হয় না। আড়ম্বর, অভিনবত্ব সবই তাকে প্রতি বছর। থাকে মণ্ডপের জাঁক, আলোর জৌলুসে টেক্কা দেওয়ার প্রতিযোগিতা। এ বার বাজেটে কাটছাঁট অবশ্যম্ভাবী। ফলে কমবে জৌলুস। সব থেকে বেশি প্রভাব পড়বে মণ্ডপ ও আলো শিল্পে।
এই জেলায় মণ্ডপ ও আলো শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে ৩৫-৪০ হাজার মানুষ যুক্ত। প্রতি বছরই দুর্গা পুজোর এক-দেড় মাস আগে থেকে কাজ শুরু হয়ে যায়। একেবারে কালীপুজো অবধি টানা কাজ থাকে। পুজোর ধাক্কা সামলে শুরু হয় বিয়ের মরসুম। পুজোর সময় ছোট, বড় ও মাঝারি— সব ডেকরেটররাই কম-বেশি বরাত পান। ভাল রোজগার হয়। মেদিনীপুর, খড়্গপুরের বড় বড় কিছু মণ্ডপে কাঁথি-সহ ভিন্ জেলার শিল্পীরাও এসে কাজ করেন। তবে স্থানীয় শিল্পীদেরও প্রচুর কাজ থাকে। কেউ করেন কাঠামোর কাজ। কেউ আবার থিমের মণ্ডপ। দর্শক টানতে দিন-রাত এক করে কাজ করেন শিল্পীরা। এ বার সবই উধাও।
মেদিনীপুরের মণ্ডপ শিল্পী সমর পাল বেশ চিন্তায়। সমর বলছিলেন, “দু-একটা কমিটির সঙ্গে প্রাথমিক কথা হয়েছে। প্যান্ডেল তৈরি নিয়ে পাকা কথা হয়নি। এবছর কী হবে, এখনই বলতে পারছি না।” ঘাটালের মণ্ডপ শিল্পী তরুণ কারক,চন্দ্রকোনা রোডের রবি পাত্ররা বলছিলেন, “পুজোর সময় বহু কাজ থাকে। বাড়তি খেটে বাড়তি আয়ও হত। এবার কেউ ডাকেনি।’’ খড়্গপুরের নেতাজি ব্যায়ামাগারের পুজো উদ্যোক্তাদের পক্ষে অঞ্জয় ঘোষ ও ঘাটালের পঞ্চপল্লির তরফে অরূপ মাজি বলেন, “আমরা অনেক আগেই বরাত দিয়ে ছিলাম। থিমও ঠিক হয়েছিল। মণ্ডপ শিল্পীকে অগ্রিমও দেওয়া হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে তো সব বন্ধ। ছোট মণ্ডপে পুজো হবে।”
গত বার যে পুজোয় মণ্ডপের বাজেট ছিল সাড়ে চার লক্ষ টাকা, এ বার তা মাত্র ২২ হাজার টাকা। ঝাড়গ্রাম শহরের একটি নামী সর্বজনীন পুজোর মণ্ডপ তৈরি করে আসছেন অতুল খিলাড়ি। অতুলের ডেকোরেটর সংস্থায় কাজ করেন ২৫ জন কর্মী। অতুল বলেন,‘‘করোনা আবহে উদ্যোক্তাদের টাকা বড়ানোর কথা বলতেও খারাপ লাগছে। কর্মীদের পাওনা-গন্ডা মিটিয়ে লাভ কিছুই থাকবে না। মণ্ডপ না বানালে পুজোই বা কেমন করে হবে। তাই কাজ ধরেছি।’’
শহরের আর এক মণ্ডপ শিল্পী অসীম সামন্ত প্রতি বছর ঝাড়গ্রামে নজরকাড়া মণ্ডপ তৈরি করেন। অন্য বছর ৫ লক্ষ বা তার বেশি বাজেটের মণ্ডপ গড়ে এসেছেন অসীম। তিনি বলেন, ‘‘মিস্ত্রি ও কর্মীরা অনেকদিন বসে রয়েছেন। তাঁদের কাজ দেওয়ার জন্য এ বার দু’টি খুবই কম বাজেটের মণ্ডপ ধরেছি। লাভের আশা ছেড়েই দিয়েছি।’’ অরণ্যশহরের আর এক মণ্ডপশিল্পী সমীর মল্লিকের আবার বক্তব্য, ‘‘এখনও কাজ ধরিনি। কারণ, তিরিশ হাজার টাকা বাজেটের মণ্ডপের কাজ করলে লাভের চেয়ে লোকসান বেশি।’’
দুর্গাপুজোর অন্যতম আকর্ষণ আলোকসজ্জা। প্রতি বছর পুজোর বেশ কিছুদিন আগে প্রাসঙ্গিক নানা বিষয়কে আলোর সাজে ফুটিয়ে তুলতে বোর্ড লাইট, গেট লাইট তৈরিতে হাত লাগান শিল্পীরা। কাপড় কিংবা থিমের মণ্ডপে ব্যবহৃত মেটাল, সোডিয়াম লাইট বা মুভি লাইট, স্পট লাইট ঠিকঠাক আছে কিনা, প্রতিনিয়ত তা দেখে নেওয়া হয়। ঘাটালের এক ডেকরেটর সংস্থার পক্ষে শান্তনু দে বলছিলেন, “দু’টো বড় থিমের মণ্ডপ করি। আলোর কাজও হয়। এ বার একটি বরাত পেয়েছি। বাজেট কম।” চন্দ্রকোনার আলো ব্যবসায়ী মৃণাল দে বলছিলেন, “এখনও বরাত পায়নি। পুজোর সময় বসে থাকব, এটা ভাবিনি।” (অভিজিৎ চক্রবর্তী ও কিংশুক গুপ্ত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy