আশা: পটনায় নিট দেওয়ার পরে বেরিয়ে আসছেন পরীক্ষার্থীরা। এমনই সমাগম হয়। ফাইল চিত্র
ভয় নিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে ঢোকা যায় না। সাফ জবাব এক পরীক্ষার্থীর। সর্বভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষা (জেইই-মেন) এবং ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষার (নিট-ইউজি) আয়োজন নিয়ে আতঙ্ক সর্বস্তরে। প্রথম পরীক্ষাটি হওয়ার কথা ১-৬ সেপ্টেম্বর। দ্বিতীয়টি ১৩ সেপ্টেম্বর। কিন্তু অতিমারির পরিস্থিতিতে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্তে দেশ জুড়ে আলোড়ন পড়েছে। পরীক্ষার্থী থেকে শিক্ষক থেকে বিরোধী রাজনৈতিক দল, আপত্তি করছে। বড় ভয় পরীক্ষা দিতে গিয়ে সংক্রমিত হলে কেরিয়ারে তার আঁচ পড়ার আশঙ্কা।
উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে পরীক্ষা নিয়ে আতঙ্ক জেলার বিভিন্নজনের কথাতেই। কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার জন্য কয়েকটি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা আবশ্যক বলে জানিয়েছেন। তা নিয়ে প্রশ্ন হলদিয়ার নিট পরীক্ষার্থী তৃশিখ বেরার। তাঁর কথায়, ‘‘তিন ঘণ্টা মাস্ক ও গ্লাভস পরে কী ভাবে পরীক্ষা দেব? এই রকম পরিস্থিতিতে পরীক্ষা না দিতে হলে সম্ভবত ভাল হত। পরীক্ষা হলে ভেতরের পরিবেশ কেমন থাকবে তা জানি না। এক-একটি পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রায় হাজার বারোশো লোকের জমায়েত হওয়ার সম্ভাবনা। আমাদের পূর্ব মেদিনীপুরে একটিও পরীক্ষাকেন্দ্র নেই। এই সময়ে গণপরিবহণ ঠিকঠাক চলছে না। কী ভাবে যাতায়াত করব সেটা নিয়ে বাবা-মা চিন্তিত।’’
মেদিনীপুরের গৌতমস্মৃতি সাতপাটি বীণাপাণি বিদ্যামন্দিরের ছাত্রী অর্পিতা দে গত বছর উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ। এ বছর নিট পরীক্ষার্থী। তাঁরও দাবি, ‘‘পরীক্ষা পিছোনো অবশ্যই দরকার। পরীক্ষাকেন্দ্র অনেক দূরে দূরে। তাই পরীক্ষা দিতে যাওয়াও সমস্যা। খুব চিন্তারও। সংক্রমণ আর একটু কমলে এ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা উচিত।’’ তাঁর স্কুলের শিক্ষক প্রশান্ত গোস্বামী বা মৌপাল দেশপ্রাণ বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক প্রসূন পড়িয়াও জানাচ্ছেন, পরীক্ষা অবশ্যই পিছনো দরকার। এখন পরীক্ষার অর্থ পরীক্ষার্থীদের আরও বিপদের মধ্যে ঠেলে দেওয়া। হলদিয়ার ছাত্রী অপরাজিতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এই পরিস্থিতিতে পরীক্ষার আয়োজনেই বিস্ময় জাগে। যদিও বলা হচ্ছে পরীক্ষা কেন্দ্রে স্ট্যান্ডার্ড প্রোটোকল মেনে পরীক্ষা নেওয়া হবে। কিন্তু যাঁরা পরীক্ষা পরিচালনা করবেন তাঁদের কেউ উপসর্গহীন করোনা রোগী থাকলে? আমাদের পরিবারে অনেকেই ৬০ বছরের ঊর্দ্ধে। একটু বেশি ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে না কি?’’
জঙ্গলমহলের পরিবহণ সমস্যার বিষয়টি উল্লেখ করলেন ঝাড়গ্রামের দহিজুড়ি মহাত্মা বিদ্যাপীঠের প্রধানশিক্ষক তথা গণিতের শিক্ষক মৃন্ময় হোতা। তিনি বলেন, ‘‘জেইই মেন ও নিট পরীক্ষার কেন্দ্র খড়গপুর, দুর্গাপুর, হাওড়া বা সল্টলেকে। এই পরিস্থিতিতে যাতায়াতের সমস্যা রয়েছে। কলকাতায় যদিও বা সরকারি বাসে যাওয়া যাবে। পরীক্ষা দিয়ে পরীক্ষার্থীদের ফেরার বাস ওই সময়ে নেই। ঝাড়গ্রাম থেকে ভাড়ার গাড়িও এখন কলকাতা যেতে চাইছে না। যদিও যাচ্ছে, কয়েক হাজার টাকা ভাড়া গুনতে হচ্ছে। জঙ্গলমঙ্গলের দরিদ্র পরিবারের পরীক্ষার্থীদের পক্ষে এত টাকা ভাড়া দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।’’ মৃন্ময়বাবুর কথায়, ‘‘বারবার পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ায় পরীক্ষার্থীদের উদ্যম হারিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীদের কাছাকাছি এলাকায় পরীক্ষা কেন্দ্র হলে ভাল হত। সেটা এখন সম্ভব নয়। তাই প্রশাসনিক ভাবে পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলে ভাল হয়।’’ হলদিয়া ডিএভি স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক অজয় বসুর যুক্তি, ‘‘অসম্ভব মানসিক চাপে ছেলে মেয়েরা পরীক্ষা দেবে। একটানা পরীক্ষায় বসতে হবে। মাস্ক খোলা যাবে না। ১৬ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে দু’জন করে অভিভাবক এলেও সংখ্যাটা বিরাট। করোনার সময়ে বহু ছাত্র-ছাত্রী গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। হলদিয়া থেকে কাছাকাছির দু’টি সেন্টার হল খড়গপুর এবং দুর্গাপুর। কী ভাবে তারা সেই সেন্টারে পৌঁছবে সেটা চিন্তার বিষয়।’’ অজয়ের মত, পুজোর পরে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারত। জানুয়ারি থেকে মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্লাস চালু করার ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা ছিল না।
ঝাড়গ্রাম ব্লকের বাঁধগোড়া অঞ্চল উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জীববিদ্যার শিক্ষক তমাল চক্রবর্তী অন্য একটি সমস্যার কথা বললেন। তাঁর কথায়, ‘‘পরীক্ষার্থী করোনায় আক্রান্ত হলে এই বছরের জন্য সে পরীক্ষায় বসতে পারল না। সেই ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে নির্দেশিকায় স্পষ্ট বলা নেই। নিট-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় বসার আগে মানসিক ভাবে যে প্রস্তুতির দরকার হয় এই পরিস্থিতিতে সেটা সম্ভব নয়। এই পরীক্ষাগুলোয় সম্পূর্ণ দেহতল্লাশি হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে তা কোনও ভাবেই সম্ভব নয়।’’ হলদিয়ার পৌর পাঠভবনের গণিতের শিক্ষক অসীম মাইতি বললেন, ‘‘আমেরিকা হঠাৎ স্কুল খুলে যে বিপদে পড়েছিল সেদিকেই হাঁটছি আমরা। হঠাৎ করে লাখ লাখ ছাত্র-ছাত্রীকে বড় পরীক্ষার মুখে ঠেলে দেওয়া কার্যত বিপদের মুখে ফেলে দেওয়া। অতীতেও পরীক্ষা বন্ধ হয়েছে। জীবন আগে। পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হটকারী। ’’
তবে পরীক্ষার পক্ষেও যুক্তি দিয়েছেন কয়েকজন। যেমন মেদিনীপুরের অলিগঞ্জ ঋষি রাজনারায়ণ বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী দিশা দণ্ডপাট। তিনি বললেন, ‘‘সবরকমের সতর্কতা নিয়ে পরীক্ষা হয়ে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। কর্তৃপক্ষকে সব রকমের সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।’’ ঝাড়গ্রাম শহরের শিবু সরেন নিট পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শিবুর কথায়, ‘‘আমার পরীক্ষাকেন্দ্র খড়্গপুরে। যাঁদের দূরে পরীক্ষাকেন্দ্র তাঁদের যাতায়াতের সমস্যা তো রয়েছে। তবে পরীক্ষা হয়ে যাওয়াটাই ভাল। অনেকে এক বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছে।’’ মেদিনীপুরের চিকিৎসক কাঞ্চন ধাড়াও মনে করেন, ‘‘দূরত্ব-বিধি মেনে পরীক্ষা নিয়ে নেওয়া উচিত। বারবার পরীক্ষা পিছনোয় পরীক্ষার্থীরা মানসিক চাপের শিকার হচ্ছেন। আর সবকিছুই যখন হচ্ছে, পরীক্ষাও হতে পারে।’’ তাঁর মেয়ে সঞ্জশ্রী ধাড়া এবারের পরীক্ষার্থী। কাঞ্চনের কথায়, ‘‘বেশি করে পরীক্ষা কেন্দ্র করলে সমস্যা হবার কথা নয়।’’
(তথ্য সহায়তা: কিংশুক আইচ, কিংশুক গুপ্ত, আরিফ ইকবাল খান)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy