হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সিদ্ধার্থ ঘোষ। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র
কাটমানি থেকে বেআইনি জমি-বাড়ি, বিতর্ক তাঁর বরাবরের সঙ্গী। শহিদ মাতঙ্গিনী পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, তৃণমূলের সেই ডাকাবুকো নেতা দিবাকর জানার বিরুদ্ধে এ বার কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের এক অফিসারকে বেধড়ক মারধর করার অভিযোগ উঠল। বৃহস্পতিবারের ওই ঘটনায় কোলাঘাট থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। তারপর দিবাকরের পাশে নেই তাঁর দলও।
এ দিন রাতেই তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসির জেলা সভাপতি দিব্যেন্দু রায় বলেন, ‘‘সংগঠনের রাজ্য সভানেত্রী দোলা সেনের নির্দেশে দলের শ্রমিক সংগঠনের অনুমোদিত কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র জাতীয়তাবাদী ঠিকা মজদুর ইউনিয়নের কার্যকরী সভাপতি দিবাকর জানা ও সম্পাদক সেলিম আলিকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওই সংগঠনের কমিটিও ভেঙে দেওয়া হয়েছে।’’
তৃণমূলের জেলা সভাপতি শিশির অধিকারী বলেন, ‘‘দিবাকর জানা অন্যায় করেছে, অপরাধ করেছে। ওকে এবং সেলিম আলিকে দল থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। কেন সে এমন কাজ করল সাত দিনের মধ্যে দিবাকরতে তার কারণ জানাতে বলা হয়েছে। পুলিশকেও উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।’’
সাপুলিশ ব্যবস্থা নেবে। আমরা চাই পুলিশ এ ধরনের অন্যায়কে কড়া হাতে দমন করুক। দলের নেতা বা যেই হোক না কেন, আইন যে নিজের হাতে তুলে নেবে পুলিশকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’’
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সিদ্ধার্থ ঘোষ। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র
কাটমানি থেকে সমবায় সমিতির জমিতে বেআইনি ভাবে বাড়ি তৈরি, রাস্তা তৈরির নামে দুর্নীতি-সহ দিবাকরের বিরুদ্ধে দলের মধ্যে থেকেই একাধিক অভিযোগ উঠেছে। যা নিয়ে জেলা তৃণমূল শিবিরও অস্বস্তিতে। এমনকী তাঁর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ যে দল ভালভাবে নিচ্ছে না, তারও প্রমাণ মেলে তৃণমূল আয়োজিত পাঁশকুড়ার নিহত তৃণমূল নেতা কুরবান শা’র স্মরণসভায়। সেখানে দলের জেলা সভাপতি শিশির অধিকারীর সঙ্গে দিবাকর করমর্দন করতে গেলে শিশিরবাবু হাত সরিয়ে নেন। সেইসঙ্গে দিবাকরের ডানা ছাঁটাও শুরু হয় বলে দলীয় সূত্রে খবর। যদিও দিবাকর তা অস্বীকার করেন। কিন্তু এ বার কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তরক্ষী ও এক আধিকারিককে তাঁর ও তাঁর অনুগামীদের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ ওঠায় শোরগোল উঠেছে। ক্ষুব্ধ জেলা তৃণমূল নেতৃত্বও।
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম এম হাসান বলেন, ‘‘কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে এক অফিসারকে মারধরের ঘটনায় দিবাকর জানা-সহ তিনজনের বিরুদ্ধে এফএইআর করেছে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।’’
শহিদ মাতঙ্গিনী পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দিবাকর জানা কোলাঘাট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তৃণমূল শ্রমিক সংগঠণের কার্যকরী সভাপতিও। পাশাপাশি কোলাঘাট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই তোলার দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি ঠিকা সংস্থার মালিকও তিনি। পুলিশ ও কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সূত্রে খবর, এদিন দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ দিবাকর জানা গাড়ি নিয়ে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বেরোনোর সময় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রশাসনিক ভবনের মূল ফটকের সামনে কর্তব্যরত নিরাপত্তা রক্ষী দিবাকরের গাড়ির ডিকি পরীক্ষা করতে চান। দিবাকর রাজি না হওয়ায় বচসা বাধে। তৈরি হয় বিতর্ক। অভিযোগ এরপর দিবাকর ফোন করে জনা পঞ্চাশেক লোক ডেকে আনেন। দিবাকরের অনুগামীরা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্তব্যরত জনা দশেক নিরাপত্তারক্ষীকে মারধর করে বলে অভিযোগ। খবর পেয়ে কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে মানব সম্পদ দফতরের আধিকারিক সিদ্ধার্থ ঘোষকে সেখানে পাঠান। অভিযোগ দিবাকর ও তাঁর অনুগামীরা তাঁকেও মারধর করে। মারের চোটে তাঁর কান, মুখ ফেটে যায়। কানে তিনটি সেলাই দিতে হয়েছে বলে দাবি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষের। সিদ্ধার্থবাবুকে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। ঘটনার পর কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ দিবাকর জানা, শান্তিপুর-১ পঞ্চায়েতের প্রধান সেলিম আলি সহ তিনজনের বিরুদ্ধে কোলাঘাট থানায় এফআইআর দায়ের করেছেন।
তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমাদের একজন নিরাপত্তারক্ষী নিয়ম অনুযায়ী দিবাকর জানার গাড়ির ডিকি পরীক্ষা করতে গেলে উনি রাজি না হয়ে কিছু লোককে ডেকে আমাদের আট-দশজন নিরাপত্তারক্ষীকে মারধর করেন। সিদ্ধার্থ ঘোষ নামে আমাদের এক আধিকারিককেও মারধর করা হয়। তাঁকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় পাঠানো হয়েছে।’’
দলেরই এক নেতার বিরুদ্ধে কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের এক অফিসারকে মারধরের ঘটনায় অস্বস্তিতে জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব। এতে কি দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হল? শিশিরবাবুর জবাব, ‘‘দলের ভাবমূর্তি আমরা বুঝে নেব। দলের ভাবমূর্তি কেমন মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছে। পুলিশ তার ন্যায্য কাজ করবে। দলের নীতিই হচ্ছে এ সব যারা করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।’’
মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন দিবাকর, তাঁর পাল্টা দাবি, ‘‘কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ঠিক শ্রমিক ইউনিয়নের মিটিং সেরে ফেরার সময় একজন নিরাপত্তারক্ষী আমার গাড়ি পরীক্ষা করতে চান। সেই সময় সিদ্ধার্থ ঘোষ ও একজন সিকিউরিটি অফিসার এসে আমার জামার কলার ধরে টেনে নিয়ে যান। তখন একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যায়। আমাদের এক শ্রমিককেও মারধর করা হয়। আমি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার ও ওই আধিকারিকের পদত্যাগ দাবি করছি। আমাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হলে আগামীকাল থেকে তার প্রতিবাদে নামব।’’ এ দিন রাতে পাল্টা ওই আধিকারিকের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy