Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

গাছ কাটা ভুলে সবুজের স্বপ্ন বুনছে খোয়াব গাঁ

এই সচেতনতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছে কলকাতার ‘চালচিত্র অ্যাকাডেমি’। বিভিন্ন শিল্পীর সমন্বয়ে গঠিত এই সংস্থার হাত ধরে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন খোয়াব গাঁয়ের বাসিন্দারা।

ষষ্ঠীচরণ আহির। —নিজস্ব চিত্র

ষষ্ঠীচরণ আহির। —নিজস্ব চিত্র

কিংশুক গুপ্ত
ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০১৯ ০১:২৪
Share: Save:

একটা সময় জঙ্গলের গাছ কেটে বিক্রি করে সংসার চালাতেন নবীর আহির, সন্তোষ ভুক্তা, দুর্গারানি ভুক্তারা। কিন্তু এখন তাঁরা বুঝেছেন, গাছ বাঁচলে তাঁরাও বাঁচবেন। এখন আর গাছ কাটার কথা স্বপ্নেও ভাবে না ‘খোয়াব গাঁ’য়ের লোধা পরিবারগুলি।

আদিম জনজাতির বাসিন্দারা এখন জোর দিয়েছেন সবুজায়নে। এই সচেতনতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছে কলকাতার ‘চালচিত্র অ্যাকাডেমি’। বিভিন্ন শিল্পীর সমন্বয়ে গঠিত এই সংস্থার হাত ধরে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন খোয়াব গাঁয়ের বাসিন্দারা। রবিবার গ্রামের চারপাশে নানা ধরনের ফল ও ফুলের গাছের চারা রোপণ করেন বাসিন্দারা। গাছ বড় হলে তার ফলে সকলের সমান অধিকার থাকবে। প্রত্যেক গ্রামবাসী একটা করে গাছের পরিচর্যার দায়িত্ব নিয়েছেন।

এ দিন রোপণ করা হয় ৭৫টি গাছ। এ ভাবেই প্রতি বছর পর্যায়ক্রমে গাছ রোপণ করে বড় করে তোলার দায়িত্ব নিয়েছেন লোধারা। গ্রামবাসী ষষ্ঠীচরণ আহিরের জন্ম থেকে বাঁ হাত নেই। এক হাতেই গাছের চারা পুঁতে ষষ্ঠী বললেন, ‘‘এক সময় ভাবতাম জীবনে আমার কিছুই করার নেই। এখন আমি নিজে ছবি আঁকি। গ্রামের ছোটদের আঁকা শেখাই।’’ স্কুল পড়ুয়া পূজা আহির, দীপা আহিররাও বলছে, ‘‘গ্রামের চারপাশে সবুজ বলয় তৈরি করে আমরা সবুজ সেনানী হতে চাই।’’

ঝাড়গ্রাম ব্লকের রাধানগর পঞ্চায়েতের অধীন গ্রামটির প্রকৃত নাম ‘লালবাজার’। সব মিলিয়ে ১৩টি লোধা পরিবারের বাস এখানে। গ্রামের জনসংখ্যা মাত্র ৭৫ জন। ঝাড়গ্রাম শহরের কদম কানন এলাকায় নির্মীয়মান পুলিশ লাইনের পাশ দিয়ে সরু মাটির রাস্তা জঙ্গলের বুক চিরে চলে গিয়েছে এই গ্রামের দিকে। গত ডিসেম্বরে চালচিত্র অ্যাকাডেমি-র প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক চিত্রশিল্পী মৃণাল মণ্ডল ও তাঁর সহযোগীরা এই গ্রামেই গড়ে তোলেন ‘ওপেন স্টুডিয়ো’। গ্রামের কচিকাঁচাদের নিকটবর্তী শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে পাঠানোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। গ্রামে আঁকা শেখানোর স্কুল চালু করেছে সংস্থাটি। সেখানে আঁকা শেখে লোধা সম্প্রদায়ের শিশু-কিশোর-কিশোরীরা। জঙ্গল ঘেরা গ্রামে মাটির বাড়ির দেওয়ালগুলি সেজেছে রং-তুলিতে। কলকাতার নামী শিল্পীদের পাশাপাশি লোধা ছেলেমেয়েরাই সে ছবি এঁকেছে।

মৃণালরাই লালবাজার গ্রামের নতুন নাম দিয়েছেন খোয়াব গাঁ। মৃণাল বলেন ‘‘আদিম জনজাতির মানুষ গুলির মধ্যেও প্রতিভা লুকিয়ে রয়েছে। ওরাও স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সেই স্বপ্নের বাস্তাবায়ন নানা কারণে হয়ে ওঠে না। খুব সীমিত পরিসরে আমরা খোয়াব গাঁয়ের পরিবারগুলিকে শিল্পের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে তুলতে চাইছি। পরিবেশ সম্পর্কে তাঁদের সচেতন করে তুলতে চাইছি।’’

তবে সমস্যাও রয়েছে। গ্রাম থেকে নিকটবর্তী খয়রাশুলি শিশুশিক্ষা কেন্দ্রটি আড়াই কিলোমিটার দূরে। খুদে পড়ুয়ারা জঙ্গলপথে হেঁটে যাতায়াত করে। গ্রামের মাত্র দু’জন কিশোরী কিলোমিটার চারেক দূরে সেবায়তন বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ে। গ্রামের কোনও বাড়িতেই এখনও সরকারি শৌচাগার হয়নি। মাটির রাস্তাও বেহাল। বাসিন্দাদের অনেকের উপজাতি শংসাপত্র নেই। বছর খানেক আগেও বেশির ভাগ পরিবারের নারী-পুরুষ জঙ্গলের কাঠ কেটে মাথায় বয়ে নিয়ে গিয়ে মহাজনদের কাছে বিক্রি করে দিতেন। তাতেই সংসার চলত। চালচিত্র অ্যাকাডেমির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শিল্পী জয়তী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘জঙ্গল ফুরিয়ে গেলে কী কী সমস্যা হতে পারে সেগুলো ওদের বোঝানো হয়। মাস আটেকের চেষ্টায় সুফলও মিলেছে।’’

গাছ কাটা বন্ধ করে নবীন আহির, দুর্গা ভুক্তার মতো অনেকেই এখন খেতমজুরি করতে যান অন্যের জমিতে। ভূপতি মল্লিক, শ্রীপতি মল্লিকরা রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করছেন। প্রবীণ কালিপদ ভুক্তা বলেন, ‘‘এখন গ্রামের কেউ আর জঙ্গলের শালগাছ কাটে না। আমরা সারা জীবন যত গাছ কেটেছি, তার থেকেও অনেক বেশি গাছ লাগানোর প্রতিজ্ঞা করেছি।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy