পরিকাঠামো না থাকার যুক্তিতে গত বছর পশ্চিমবঙ্গে এমবিবিএসের বাড়তি ১১৯৫ আসনে ছাত্র ভর্তি আটকে দিয়েছিল জাতীয় মেডিক্যাল কাউন্সিল (এমসিআই)। সেই সমস্ত আসনে ভর্তির অনুমতি পেতে গলদঘর্ম হতে হয়েছিল রাজ্যের স্বাস্থ্য কর্তাদের। তা-ও অনুমতি মিলেছিল দফায় দফায়। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সেই পশ্চিমবঙ্গেরই ভূয়সী প্রশংসা করে রাজ্যের ১৩টি মেডিক্যাল কলেজের ১০৯৫টি আসনে ছাত্র ভর্তির ঢালাও ছাড়পত্র দিয়ে দিল এমসিআই। গত ১৪ জুন এই মর্মে রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে চিঠিও এসে গিয়েছে।
ব্যতিক্রম শুধু কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকের অধীনে থাকা জোকার ইএসআই মেডিক্যাল কলেজ। সেখানে বাড়তি ১০০টি আসন বহাল রাখার আর্জিতে সবুজ সঙ্কেত মেলেনি। এমসিআই সূত্রের খবর, ওই মেডিক্যাল কলেজটি শ্রম মন্ত্রক আর তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় না। পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে তারা মেডিক্যাল কলেজটি অধিগ্রহণ করতে বলেছিল। কিন্তু সেই কাজ আর এগোয়নি। নিয়ন্ত্রক কে হবে, তা ঠিক না হওয়ায় জোকার মেডিক্যাল কলেজে আসন বাড়ানোর আর্জি মানেনি এমসিআই।
তবে বাকি ১০৯৫টি আসনে ছাত্র ভর্তির অনুমোদন দিয়ে রাজ্য সরকারকে লেখা চিঠিতে এমসিআইয়ের প্রধান জয়শ্রীবেন মেটা খোলাখুলি বলেছেন, ‘মেডিক্যাল কলেজগুলির পরিকাঠামো সংস্কারের কাজে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম সারিতে রয়েছে। তাই বাড়তি আসনের অনুমতি দিতে আমরা দেরি করিনি।’ জয়শ্রীবেনের যুক্তি, পরিকাঠামো উন্নয়নে পশ্চিমবঙ্গকে যা-যা করতে বলা হয়েছিল, তা অতি চমৎকার ভাবেই করা হয়েছে। দ্রুত কাজ এগিয়েছে। পরিকাঠামোগত দিক থেকে সামান্য কাজই এখন বাকি। তাঁরা খুবই সন্তুষ্ট।
গত বছর কিন্তু এমসিআইয়ের সুর ছিল পুরো উল্টো। পরিকাঠামোয় ঘাটতির কথা বলে প্রথমে এমবিবিএসের বাড়তি ১১৯৫ আসনে ছাত্র ভর্তি আটকে দেওয়া হয়। অনেক সাধ্যসাধনার পর, বহু বার দিল্লি গিয়ে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতে হয়েছিল রাজ্যের স্বাস্থ্য কর্তাদের। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লিতে চিঠি লেখেন। এমনকী বিরোধী সিপিএমের প্রতিনিধিদলও গিয়ে দেখা করে তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধনের সঙ্গে। শেষমেশ মুচলেকা দিয়ে ধাপে ধাপে (প্রথমে ৪০০, পরে বাকি ৭৯৫) ওই আসনগুলিতে ছাত্র ভর্তির অনুমতি পায় রাজ্য। সেগুলিতে এ বছরও যাতে ছাত্র ভর্তি করা যায়, তার জন্য এমসিআইয়ের কাছে ফের আর্জি জানিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। সেই অনুমতি যে এত অনায়াসে মিলবে, তা ভাবতেই পারেননি স্বাস্থ্য কর্তাদের অনেকে।
প্রশ্ন হল, কেন এমন দরাজ এমসিআই?
স্বাস্থ্য মন্ত্রকের একটি সূত্রের বক্তব্য, এমসিআই-এর এই সিদ্ধান্তের পিছনে রয়েছে দেশে জন-প্রতি চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্য। তাঁর দাবি, গত বার মেডিক্যাল কলেজগুলিতে বাড়তি আসনে অনুমোদন দেওয়া নিয়ে কড়াকড়ি হওয়ায় স্বাস্থ্য মন্ত্রক ক্ষুব্ধ হয়েছিল। এমসিআইয়ের প্রতিনিধিদের ডেকে এ ব্যাপারে সতর্কও করে দেওয়া হয় বলে খবর।
মন্ত্রকের যুক্তি ছিল, এমনিতেই দেশে ডাক্তার-পিছু রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৭০০। এই অনুপাত কমিয়ে না আনলে অধিকাংশ মানুষই স্বাস্থ্য পরিষেবার বাইরে থেকে যাবেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রক চায়, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে প্রতি ১ হাজার রোগীর জন্য ১ জন চিকিৎসক থাকুন। কিন্তু এমসিআই কড়াকড়ি করলে সেই লক্ষ্যমাত্রায় কোনও দিনই পৌঁছনো যাবে না বলে তারা মনে করছে।
কেউ কেউ অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের জন্য এমসিআইয়ের এই কল্পতরু হওয়ার পিছনে নরেন্দ্র মোদী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পারস্পরিক রসায়নে সাম্প্রতিক বদলের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তবে এমসিআই প্রধানের দফতর সূত্রের দাবি, বাড়তি আসনে ছাত্র ভর্তিতে কড়াকড়ি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ-সহ একাধিক রাজ্য অসন্তোষ জানিয়েছিল। তাই সারা দেশেই ১৬১টি মেডিক্যাল কলেজের বাড়তি সাড়ে ১১ হাজার আসনে এ বছর এমবিবিএসে ছাত্র ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এমসিআই প্রধানও বলেছেন, ‘‘কেউ আমাদের উপরে কোনও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়নি।’’
কলকাতার একটি মেডিক্যাল কলেজের অবসরপ্রাপ্ত এক অধ্যক্ষ অবশ্য মনে করছেন, এমসিআই গত বারের মতো পরিকাঠামো নিয়ে কড়াকড়ি বজায় রাখলে কাজের কাজ হতো। ওই শিক্ষক-চিকিৎসকের মন্তব্য, ‘‘পরিকাঠামো ঠিক না হলে শিক্ষা এবং সম্পূর্ণ হয় না। এমসিআই সহজেই অনুমোদন দিয়ে দেওয়ায় পরিকাঠামো নিয়ে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে কুমিরছানা দেখানো আবার শুরু হবে।’’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জগৎপ্রকাশ না়ড্ডা-র দফতরের অফিসার অন স্পেশ্যাল ডিউটি প্রদীপকুমার ঠাকুরের কাছে। সব শুনে তাঁর মন্তব্য, ‘‘যখন ২০১৫-’১৬য় এক বারেই পশ্চিমবঙ্গের মেডিক্যাল কলেজগুলি বাড়তি আসনে এমবিবিএসে ছাত্র ভর্তির অনুমতি পেয়ে গিয়েছে, তখন আর কার্যকারণ ভাবতে বসা কেন? কে কাকে কী বলেছে না খুঁজে বরং পশ্চিমবঙ্গের আনন্দ করা উচিত।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy