চিন, বাংলাদেশ, রাশিয়া, ইউক্রেন, নেপাল, কাজাখস্থান....
তালিকাটা লম্বা। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে বাইরের এমন অনেক দেশের নানা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারির ডিগ্রি নিয়ে ফিরছেন ভারতের বহু ছেলেমেয়ে, যাদের বড় একটা অংশকে নিয়ে ঘোর বিড়ম্বনায় পড়েছে মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই)। কারণ, ওই বিদেশি ডিগ্রিধারীরা স্বদেশে প্র্যাক্টিস করার বৈধ যোগ্যতাই অর্জন করতে পারছেন না! অভিযোগ, তাঁদের অনেকে অবৈধ ভাবে রোগী দেখছেন, ফলে চিকিৎসা বিভ্রাটের সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে।
ঘটনা হল, এই ধরনের বিদেশি মেডিক্যাল কলেজে পঠনপাঠনের মান এমসিআই সন্দিহান। তাই ওখান থেকে পাশ করে এলে ভারতে সরাসরি রেজিস্ট্রেশন মেলে না। এ জন্য ন্যাশনাল বোর্ড অফ এগজামিনেশন (এনবিই)-এর প্রবেশিকায় (ফরেন মেডিক্যাল গ্রাজুয়েটস এগজামিনেশন, সংক্ষেপে এফএমজিই) পাশ করতে হয়। ওতে যাঁরা উতরে যাচ্ছেন, তাঁদের নিয়ে সমস্যা নেই। কিন্তু ফেল করাদের নিয়েই সমস্যা। রেজিস্ট্রেশন না–থাকায় ওঁরা দেশে প্র্যাক্টিস করতে পারছেন না।
এবং ফি বছর এঁদের সংখ্যা বাড়ছে। এমসিআইয়ের হিসেবে, এনবিই-তে পাশের হার সাকুল্যে ১৯%-২০%। ২০১২ থেকে ২০১৪— এই তিন বছরে চিন, বাংলাদেশ, রাশিয়া, ইউক্রেন, নেপাল, কাজাখস্থান থেকে এমবিবিএস পাশ করা প্রায় ২৬ হাজার জন এফএমজিই’তে বসেছিলেন। উতরেছেন মাত্র পাঁচ হাজার। গত বছর পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৫৩৪৯। রোগী দেখার ছাড়পত্র পেয়েছেন ছ’শো জন। যে প্রায় ৮০% ব্যর্থ হচ্ছেন, তাঁদের কী হাল? এমসিআইয়ের পর্যবেক্ষণ: ওঁরা বিভিন্ন ক্লিনিক বা বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করছেন। ‘‘অকৃতকার্যেরা প্রত্যেকে আইন ফাঁকি কোথাও না কোথাও রোগী দেখছেন। নামের পাশে এমবিবিএস ডিগ্রিও বসাচ্ছেন দিব্যি।’’— মন্তব্য এনবিই’র এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর বিপিন বাত্রার। কেউ কেউ চুটিয়ে প্রাইভেট প্র্যাক্টিসও করছেন বলে অভিযোগ। কী ভাবে এটা সম্ভব হচ্ছে?
বাত্রার ব্যাখ্যা: ‘‘সাধারণ মানুষ সব সময় ডাক্তারবাবুর রেজিস্ট্রেশন নম্বর জানতে চান না। ডাক্তারবাবু এফএমজিই পাশ করেছেন কিনা, তা নিয়েও মাথা ঘামান না। এই সুযোগে ওঁরা পার পেয়ে যাচ্ছেন।’’ এমসিআই কী করছে?
কাউন্সিলের এক কর্তা স্বীকার করেছেন, নজরদারি চালানোর মতো পরিকাঠামো বা লোকবল নেই। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘বুঝতে পারছি, ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না। অথচ কিছু করার নেই।’’ সমস্যাটা দিন দিন বাড়বে বই কমবে না বলেই এমসিআইয়ের আশঙ্কা। কেন?
কর্তাদের মতে, ডাক্তারির সর্বভারতীয় প্রবেশিকা (নিট) চালু হওয়ায় দেশের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতেও ভর্তি কঠিন হবে। শুধু টাকা দিয়ে আসন মিলবে না। তখন বিদেশে যাওয়ার ঝোঁক আরও বাড়বে। এফএমজিই’তে ঠোক্কর খেয়ে বেআইনি প্র্যাক্টিস করা ডাক্তারের সংখ্যাও বাড়বে। এনবিই-র সদ্য প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট ভবতোষ বিশ্বাসের কথায়, ‘‘বারো ক্লাসের পরীক্ষায় ৫০%-৫৫% পেয়েও অনেকে ডাক্তার হতে চিন, নেপাল, ইউক্রেন, বাংলাদেশে দৌড়চ্ছে! ওই বিদেশি ডিগ্রিধারীদের অনেকে এখানে সোজা পথে রেজিস্ট্রেশন না-পেয়ে বেআইনি ভাবে রোগী দেখছে। কিন্তু হাতেনাতে ধরা যাচ্ছে না।’’
এমতাবস্থায় ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের উদ্দেশে এমসিআইয়ের আহ্বান— বিদেশে ডাক্তারি পড়তে যাওয়ার আগে সেখানকার পঠনপাঠন সম্পর্কে খোঁজখবর নিন। পরে রেজিস্ট্রেশনের পরীক্ষায় পাশ করতে না-পারলে হাতুড়ের সঙ্গে কোনও ফারাক থাকবে না। ‘‘এতেও অবশ্য অনেকের হুঁশ ফিরছে না।’’— খেদ করছেন কাউন্সিলের এথিক্স কমিটির সদস্য সুদীপ্ত রায়।
আরও কিছু বন্দোবস্তের কথা ভাবা হচ্ছে। বিদেশে ডাক্তারি পড়তে যাওয়ার আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রকের আনুষ্ঠানিক অনুমতি লাগে। এমসিআই ও এনবিই-র তরফে গত মাসে দিল্লিকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, বারো ক্লাসের পরীক্ষায় ৬০%-৬৫% ছাড়া কাউকে যেন অনুমতি না দেওয়া হয়। তাতে কিছুটা ভাল মানের পড়ুয়া ছেঁকে নেওয়া যাবে। ‘‘এঁদের যাঁরা এফএমজিই’তে ফেল করবেন, তাঁদের দেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে শর্ট কোর্স করিয়ে ফের পরীক্ষায় বসার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।’’— বলছেন এক এমসিআই-কর্তা। তাঁর মতে, দেশে রেজিস্টার্ড ডাক্তারের অভাব আছে। এই পথে ঘাটতি মিটতে পারে। দিল্লির খবর, ব্যাপারটা ভেবে দেখা হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy