কেন বিয়ে হচ্ছে না গ্রামের যুবকদের? প্রতীকী চিত্র।
পাত্রের পৈতৃক বাড়ি আছে। চাষযোগ্য জমি, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি মিলিয়ে রয়েছে কয়েক লক্ষ টাকা। নিজেও কাজ করেন। তবুও সেই তাঁকে পাত্রস্থ করতে হিমসিম পরিবার। শুধু তিনিই নন। এমন সমস্যার পড়েছেন বহু বিবাহযোগ্য যুবক। এর কারণ আর কিছুই নয়— গ্রামের অবস্থা!
মালতী দেবীর ছেলের বয়স হয়েছে ৩০ বছর। সেই ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন তিনি। পাত্রীপক্ষ শর্ত দিয়েছে, ওই গ্রাম ছাড়লে তবেই হতে পারে বিয়ে। বিয়ের জন্য কি শেষে ভিটেমাটি ছাড়তে হবে? হ্যাঁ, এ রকম সমস্যায় পড়েছেন নদিয়ার নাকাশিপাড়া ব্লকের অন্তর্গত বীরপুর ১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের মোটাবড়িগাছি গ্রামের যুবকরা।
মোটাবড়িগাছি ‘আজব’ গ্রাম। এমন গ্রামের কোনও পাত্রের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে রাজি হচ্ছে না বহু পরিবার। কিন্তু গ্রামের জন্য কেন বিয়ে হবে না? এই অবস্থার জন্য গ্রামের পরিকাঠামোকে দায়ী করছেন গ্রামের বাসিন্দারা। ভৌগোলিক ভাবে প্রত্যন্ত এলাকা। তার উপর রাস্তা নেই, নেই পানীয় জলের সুষ্ঠু ব্যবস্থা। প্রায়শই বিদ্যুৎ-বিভ্রাট ঘটে। ‘‘কে-ই বা আসবেন এই গণ্ডগ্রামে’’— আক্ষেপের সুরে বলছেন ২৭ পেরোনো যুবক সুবীর।
বীরপুর ১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় প্রায় সাত হাজার মানুষের বসবাস। এই গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, কেন্দ্র কিংবা রাজ্য সরকারের উন্নয়নমূলক প্রকল্পের ছিটেফোঁটা সুবিধাও এখানে পৌঁছায়নি। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা এবং বাংলা আবাস যোজনাকে নিয়ে রাজ্য রাজনীতি যতই সরগরম হোক, এখানে সে সবের বালাই নেই। কারণ, অধিকাংশই বাড়িই কাঁচা। পুরুষদের পেশা বলতে মূলত চাষবাস এবং পশুপালন। এর বাইরে বেরোতে পারেননি প্রায় কেউই।
শিক্ষার ব্যবস্থাও তথৈবচ। দুটো স্কুল আছে বটে, তবে সে দুটিও পাঁচ থেকে সাত কিলোমিটার দূরে। কিন্তু ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতের কারণে ধুঁকছে সেই স্কুল। এলাকার সিংহভাগ ছেলেমেয়ে ওই স্কুল দুটিতে পড়াশোনা করে। স্বাস্থ্য পরিষেবা বলতে বেথুয়াডহরি গ্রামীণ হাসপাতাল। যার ভৌগলিক দূরত্ব ২২ কিলোমিটার। আপদ্কালীন পরিস্থিতিতে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থাটাও নেই। রাতবিরেতে অসুস্থ হয়ে পড়লে বিপাকে পড়েন এই গ্রামের মানুষজন।
সারা গ্রাম ঘুরে একটি কংক্রিটের রাস্তাও চোখে পড়বে না। বেশ কয়েকটি গ্রাম পেরোলে তবে ছোঁয়া যায় ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক। এ সব কারণে ক্ষুব্ধ গ্রামের মানুষজন।
গ্রামের বাসিন্দা রিনা দেবী বলেন, ‘‘ছেলের বিয়ে দিতে পারছি না। কৃষিজমি-সহ অন্যান্য যা কিছু আছে তাতে দিন গুজরানে কোনও অসুবিধা হয় না। কিন্তু গ্রামের নাম শুনলেই মুখ ফেরাচ্ছে সবাই।’’ নাকাশিপাড়া ব্লকের অন্তর্গত দোগাছিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত। বীরপুর আসতে গেলে দোগাছিয়ার উপর দিয়েই আসতে হয়। এই গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত পাটপুকুর স্ট্যান্ড থেকে মোটা বড়গাছি পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা খারাপ। যা সুখসাগর গোরস্থান পাড়ার রাস্তা নামেই পরিচিত। ওই এলাকায় পঞ্চায়েতের দুটি বুথ রয়েছে। যেখানে প্রায় আড়াই হাজার মানুষের বসবাস।
গ্রামে দিনকে দিন কমছে যাতায়াতের বড় ভরসা টোটোর সংখ্যাও। টোটোচালকদের বক্তব্য, ‘‘আমাদের এলাকার রাস্তাঘাট একদম ভাল নয়। ভাঙাচোরা রাস্তা নিয়ে গাড়ি নিয়ে গেলে যন্ত্রপাতি খারাপ হয়ে যায়। অধিকাংশই এ দিকে আসতে চায় না।’’ বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দোগাছিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের পাটপুকুর আর বীরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের মোটাবড়গাছি— এই গোটা এলাকাই যেন অঘোষিত ভাবে সামাজিক বয়কটের শিকার! দূর গ্রামের কোনও পরিবারই এই এলাকার লোকজনের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চান না।
এ নিয়ে নাকাশিপাড়ার বিডিও কল্লোল বিশ্বাসের বক্তব্য, ‘‘জাতীয় সড়ক থেকে ভিতর দিকে যেতে অনেকটা রাস্তার কাজ হয়েছে। তবে গ্রামীণ এলাকায় অনেক জায়গায় রাস্তার কাজ বাকি রয়েছে। কিছু মাটির রাস্তা রয়েছে। পঞ্চায়েতগুলো উদ্যোগ নিয়েছে। এর ব্যবস্থা হবে।’’
বছর ঘুরলেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। এই অবস্থার কি পরিবর্তন হবে? উত্তর খুঁজছে বীরপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার মানুষজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy