কচি হাতের এই সব লেখা দেখেই উদ্বিগ্ন স্কুল। নিজস্ব চিত্র
বন্ধ মনের আগল খুলতেই বেরিয়ে পড়ল বিষাদসিন্ধু। ছেঁড়া পাতায় আঁকাবাঁকা অক্ষরে কেউ লিখেছে, ‘বাবা-মা কেউ আমায় ভালবাসে না।’ কেউ লিখেছে, মা নেই। বন্ধুর মায়েরা তাদের কত ভালবাসে! একটিতে লেখা, ‘আমরা খুব গরিব। বাবাকে পেনসিল বক্স কিনে দিতে বলেছিলাম। বাবা দিতে পারেনি।’
শিশুমনের এমন সব স্বীকারোক্তি জেনে স্তম্ভিত শিক্ষকেরা। ৩০ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের দল জেলার স্কুলগুলিতে মিড-ডে মিল প্রকল্প পরিদর্শনে আসেন। রাজ্যের তরফে স্কুলগুলিকে প্রস্তুতির জন্য কিছু নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ছোটদের মনের কথা জানতে ‘ড্রপবক্স’ রাখার কথাও ছিল সেই তালিকায়।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার রায়দিঘি মথুরাপুর ২ ব্লকের দিঘিরপাড় বকুলতলা প্রাথমিক স্কুলেও রাখা হয়েছিল সেই বাক্স। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের ডেকে শিক্ষকেরা বলেছিলেন, মনের কথা লিখে জানাও। কেউ কিছু বলবে না। যা খুশি লিখতে পারো। প্রথমটায় কেউ সাহস পায়নি। শিক্ষকেরা অভয় দেওয়ার পরে কয়েক জন রাজি হয়। আশপাশে কারও চোখে পড়বে না তো, এ কথা ভেবে অনেক আড়াল-আবডাল করে দু’চার কথা লিখেও ফেলে।
জমা পড়ে ডজনখানেক চিরকুট। ছেঁড়া কাগজের টুকরোগুলো মেলে ধরে হতবাক শিক্ষকেরা। দমচাপা কষ্টের রোজনামচা উঠে এসেছে এক-দু’লাইনেই। এক জন লিখেছে, মা প্রতি দিন মারধর করে। আর এক জন চায় নাচ শিখতে। কিন্তু রাজি নন বাবা।
দিঘিরপাড় বকুলতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিখিলকুমার সামন্ত বলেন, ‘‘শিশুমনের গভীরে এত কষ্ট রয়েছে, ভাবতেও পারিনি। চিরকুটগুলি পড়তে পড়তে আমাদের চোখে জল এসে গিয়েছে। ঠিক করেছি, ছেলেমেয়েগুলোর কাউন্সেলিংয়েরব্যবস্থা করব।’’ পরিবারের সঙ্গেও খোলামেলা আলোচনা করা যায় কি না, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করছেন মাস্টারমশাইরা। প্রধান শিক্ষক জানান, যতটা সম্ভব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হবে। যারা বাড়িতে সে ভাবে আদর পায় না, তাদের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হবে। ছোটখাটো যে সব জিনিসের চাহিদার কথা জানা গেল, সেগুলি স্কুলের টাকাতেই কিনে দেওয়া হবে বলে জানালেন প্রধান শিক্ষক।
গোটা বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তীর্থঙ্কর দাশগুপ্তও। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের সমাজে মনের বিষয়টিকে অবহেলা করার রেওয়াজ রয়েছে। মনের কষ্টের সঙ্গে লড়াই করতে হবে নিজেকেই— এমন একটা ধারণা ছোট থেকে শিশুদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।’’ এর ফলে ছোটরা মনের কথা কাউকে বলতে পারে না। কিন্তু কষ্ট প্রকাশ করতে না পারলে এক সময়ে ডিপ্রেশনের শিকার হতে পারে বলেও জানালেন তিনি। সমস্যা বাড়তে দিলে বাচ্চারা আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে বলেও আশঙ্কা আছে। এ বিষয়ে বাবা-মা, শিক্ষকদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মত তীর্থঙ্করের। ছোটদের আবেগ-অনুভূতি, কষ্টের কথা সহানুভূতির সঙ্গে সকলকে দেখতে হবে। এতে শিশুর মনের জোর বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
ছোট্ট মনের ছোট ছোট আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলিকে দাবড়ানি দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া নয়— বরং সেগুলির যত্ন নেওয়াই শিশুমনের প্রকৃত বিকাশের পথ হতে পারে বলে মনে করছে স্কুলও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy