—প্রতীকী ছবি।
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ব্যাঙ্ক থেকে শিক্ষা ঋণ নিয়েছিলেন বেহালার প্রীতি অধিকারী। চাকরি পাওয়ার পরে নিয়মিত মিটিয়ে যাচ্ছিলেন সেই ধার শোধের মাসিক কিস্তিও (ইএমআই)। কিন্তু বাদ সাধল কোভিড। লকডাউনে তাঁর চাকরি গিয়েছে। ফলে ইএমআই বন্ধ। সুদ-সহ ঋণের বোঝা ২.৭৩ লক্ষ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫.৫০ লক্ষ টাকা। এর থেকে উদ্ধার পাবেন কী ভাবে, তা ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছেন না প্রীতি।
মিডিয়া সায়েন্স নিয়ে শহরের এক নামী কলেজ থেকে স্নাতক মুর্শিদাবাদের শ্রুতি পাল চৌধুরী (নাম পরিবর্তিত)। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তরফে প্লেসমেন্টের (পাশ করার পরে ক্যাম্পাস থেকে চাকরি) প্রতিশ্রুতি পেয়েই শিক্ষা ঋণ নিয়েছিলেন ২০১৮ সালে। কিন্তু চাকরি জোটেনি। ৪.৫০ লক্ষ টাকার ধার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ব্যাঙ্কের খাতায় এখন শ্রুতির পরিচিতি ঋণখেলাপি হিসেবে!
প্রীতি বা শ্রুতি কোনও বিচ্ছিন্ন উদারহরণ নন, শিক্ষা ঋণ নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে তা শোধ করতে এখন নাভিশ্বাস উঠছে অনেকেরই। স্বপ্নের চাকরি তো দূর অস্ত, ঋণের মাসিক কিস্তির টাকা শোধ করতেই হিমশিম খাচ্ছেন অনেকে। ব্যাঙ্কিং সূত্রের খবর, এর কারণ মূলত তিনটি। প্রথমত, গত কয়েক বছরে উচ্চশিক্ষার খরচ বেড়েছে অনেকখানি। দ্বিতীয়ত, বছর দেড়েকের মধ্যে সুদ লাফিয়ে বাড়ায় দেনার বোঝা ভারী হয়েছে। বেড়েছে কিস্তির অঙ্ক। তৃতীয়ত, দেশে পর্যাপ্ত কাজের অভাব। অর্থাৎ, যত জন কাজের বাজারে পা রাখছেন, তার তুলনায় ভাল কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে অনেক কম। ব্যাঙ্কিং মহলের দাবি, এই ‘ত্র্যহস্পর্শেই’ অনেকে বিশ বাঁও জলে। এঁদের কেউ চাকরি পাচ্ছেন না। কারও কাজ চলে গিয়েছে। অনেকে আবার এমন বেতনের চাকরি পাচ্ছেন, যা দিয়ে ধার শোধ করাই দুষ্কর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলে, কাজে যোগ দিয়ে টাকা মেটানোর যে শর্তে ঋণ পেয়েছিলেন ওই সমস্ত পড়ুয়া, তা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়ছেতাঁদের পক্ষে।
পরিসংখ্যান বলছে, গত ৫-৭ বছরে উচ্চশিক্ষার খরচ বিপুল বেড়েছে। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ সালে এক বেসরকারি কলেজে বিটেক পড়তে লাগত ৩.২ লক্ষ টাকা।চলতি অর্থবর্ষে তা বেড়ে হয়েছে ৬.৩২ লক্ষ। আইআইটি-তে গড় ফি গত পাঁচ বছরে ৪-৫ লক্ষ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৮-১০ লক্ষ। লাফিয়েবেড়েছে ম্যানেজমেন্ট-সহ অন্যান্য অনেক শিক্ষার খরচই। বিশেষত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। ২০১২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার যেখানে ৯.৬২%, সেখানে পড়াশোনার খরচ বেড়েছে ১০%। তার উপরে, সংশ্লিষ্ট ওই ব্যাঙ্কেই ১০ বছর মেয়াদে নেওয়া ১০ লক্ষ টাকা শিক্ষা ঋণে সুদের হার আগের ৮.৬৫% থেকে বেড়ে হয়েছে ১১.০৫%। এর সঙ্গে যোগ হয়েছেচড়া বেকারত্ব।
সম্প্রতি উপদেষ্টা সংস্থা টিমলিজ়ের এক সমীক্ষা জানিয়েছে, দেশে প্রতি বছর প্রায় ১৫ লক্ষ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া স্নাতক হন। কিন্তু এই অর্থবর্ষে যা পরিস্থিতি, তাতে তাঁদের মাত্র ১০% ‘ঠিকঠাক’ চাকরি পাবেন। অর্থাৎ, অধিকাংশই প্রত্যাশা মাফিক কাজ পাবেন না। রিপোর্ট অনুযায়ী, গত অর্থবর্ষে (২০২২-২৩) তথ্যপ্রযুক্তি এবং ইঞ্জিনিয়ারিং স্নাতকদের মধ্যে ২.৩০ লক্ষ জন কাজ পেয়েছিলেন। এ বার তা নামতে পারে ১.৫৫ লক্ষে। কাজ পাওয়ার হার ৩০ শতাংশের বেশি কমার আশঙ্কা। খোদ কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকের পরিসংখ্যানেও উঠে এসেছে, গত বছরের জুলাই থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত স্নাতকদের ১৩.৪ শতাংশই কর্মহীন।
পটনা আইআইটির অর্থনীতির অধ্যাপক রাজেন্দ্র পরামানিকের বক্তব্য, “ভারতে শিক্ষা ঋণে সুদের হার ৯ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। সব থেকে বেশি সমস্যায় পড়েছেন মাঝারি মানের প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা ছেলেমেয়েরা। গত পাঁচ বছরে দেশে উচ্চশিক্ষার খরচ অনেকটা বেড়েছে। যেমন, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার খরচই বেড়েছে ১২%। পড়ুয়া শিক্ষা ঋণ না নিলে বহু বাবা-মায়ের পক্ষে তা সামলানো কঠিন। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই বোঝা বওয়ার মতো আর্থিক ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে কি? দেশে চাকরি কোথায়! তেমন বেতনই বা কে দিচ্ছে!’’ ব্যাঙ্কিং কর্তাদের দাবি, এতে যে শুধু তরুণ প্রজন্ম সমস্যায় পড়ছেন তা নয়, ব্যাঙ্কগুলিও সময়ে ধারের টাকা ফেরত পাচ্ছে না।
বন্ধন ব্যাঙ্কের কর্ণধার চন্দ্রশেখর ঘোষের দাবি, যে সব ক্ষেত্রে এখন অনুৎপাদক সম্পদের হার বেশি, তার মধ্যে অন্যতম শিক্ষা ঋণ। তবে তাঁর অভিযোগ, ‘‘বাজারে কাজের অভাব থাকলেও, এ ক্ষেত্রে একাংশ ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। চাকরি পেয়েও তা শোধ করার গরজ নেই।’’
প্রীতি জানান, ২০২০-তে চাকরি যাওয়ার পরে জমানো টাকা থেকে কিছু দিন ইএমআই দিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরে আর পারেননি। তাঁর কথায়, ‘‘২.৭৩ লক্ষ টাকা শিক্ষা ঋণ নিয়েছিলাম। এখন সুদে আসলে বকেয়া ৫.৫০ লক্ষ টাকা। কী করে শোধ করব জানি না।’’ শ্রুতি ধার নিয়েছিলেন ৪.৫০ লক্ষ টাকা। সুদ-সহ এখন তাঁরও বকেয়ার অঙ্ক বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ। অসহায় অবস্থা। সোদপুরের দ্বৈপায়ন পাল (নাম পরিবর্তিত) জানাচ্ছেন, চাকরি পেলেও তাঁর বেতন ইএমআই মেটানোর মতো নয়। সকলেরই দাবি, এত খরচ করে পড়াশোনার পরে যে কাজের বাজারে এই পরিস্থিতিতে পড়তে হবে, তা বোঝেননি তাঁরা। দ্বৈপায়ন বলেন, “সুদ বেড়ে যাওয়ায় ইএমআই বেড়েছে। অথচ টাকা মেটানোর জন্য যে রোজগার দরকার, সেটা করতে পারছি না।’’
ব্যাঙ্কিং সূত্র জানাচ্ছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির কোর্স ফি বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ানো হয়েছে ঋণদানের পরিমাণ। তা ছাড়া শুধু পাঠ্যক্রমের নয়, বেড়েছে পরীক্ষায় বসার এবং হস্টেলে থাকার খরচও। সব মিলিয়ে পড়তে টাকা লাগছে আগের থেকে অনেক বেশি। বাড়ছে ঋণের অঙ্ক। তা মেটানো আরও কঠিন হয়ে পড়ছে অনেকের পক্ষে। বিশেষত এই চড়া সুদের সময়ে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এক আধিকারিকের দাবি, গত মার্চের হিসাব অনুযায়ী ব্যাঙ্কগুলিতে সার্বিক অনুৎপাদক সম্পদের হার ছিল ৫.৯৫%। আর গত এপ্রিল-জুনের শেষে শুধু শিক্ষা ঋণেই তা ছুঁয়ে ফেলেছে ৭.৮২%।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy