Advertisement
০৪ অক্টোবর ২০২৪
R G Kar Hospital Incident

স্বার্থের রাজনীতি বাধা আন্দোলনে

১০ অগস্ট আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমি বিল্ডিংয়ের সামনে একটি গাছের তলায় একত্রিত হয়ে সতীর্থের খুন ও ধর্ষণের প্রতিবাদে প্রতিবাদ শুরু করেন জনা কয়েক চিকিৎসক-পড়ুয়া।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

শান্তনু ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৪ ০৫:০১
Share: Save:

আর জি করের ঘটনায় ন্যায়বিচারের দাবিতে শুরু হয়েছিল সঙ্ঘবদ্ধ অরাজনৈতিক আন্দোলন। কিন্তু জুনিয়র চিকিৎসকদের সেই আন্দোলনে বিভিন্ন গোষ্ঠীর ‘চাপিয়ে দেওয়ার’ রাজনীতি ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। আন্দোলনের শুরু থেকে নেতৃত্বে দেখা গিয়েছে যাঁদের, তাঁদের মতামত অনেক ক্ষেত্রেই পিছনের সারিতে চলে যাচ্ছে। ‘আপনাদের অ্যাজেন্ডা আমাদের আন্দোলনে চাপাবেন না’ বলে প্রথমে যাঁদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল আন্দোলনের মঞ্চ থেকে, কালক্রমে তাঁদের কারও কারও ভূমিকা অন্তরালে চোখে পড়ছে। ফলে দ্বিধাবিভক্ত হচ্ছে আন্দোলন।

অবস্থান বা কর্মবিরতি চালিয়ে যাওয়া প্রশ্ন তুলে দিয়েছে— ডাক্তারদের যে আন্দোলন সাধারণ মানুষের আন্দোলন হয়ে উঠেছিল, সেখানে সরকারি হাসপাতালে কাজ বন্ধ করে রেখে গরিব মানুষকে বঞ্চিত করা কোনও রাজনৈতিক অভিসন্ধিকে চরিতার্থ করছে না তো? সংশয় তীব্রতর হওয়ার কারণ রয়েছে বইকি। জুনিয়র চিকিৎসকেরা ফের যে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি শুরু করেছেন, তার শেষ কবে— বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত সেই সম্পর্কে দিশা মেলেনি। যার ফলে, পুজোয় সরকারি স্তরে চিকিৎসা পরিষেবা কতটা মিলবে, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। সেই কর্মবিরতিকে আর সমর্থন করতে পারছেন না বহু সিনিয়র চিকিৎসক। তাঁরা বলছেন, “দু’পা এগিয়ে, এক পা পিছিয়ে যাওয়াই হল আন্দোলন। এই বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে এখনও কর্মবিরতি চালানো যথাযথ পদক্ষেপ নয়।”

১০ অগস্ট আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমি বিল্ডিংয়ের সামনে একটি গাছের তলায় একত্রিত হয়ে সতীর্থের খুন ও ধর্ষণের প্রতিবাদে প্রতিবাদ শুরু করেন জনা কয়েক চিকিৎসক-পড়ুয়া। তাতে স্বর মেলান চিকিৎসক সমাজ থেকে সাধারণ মানুষ।। তখনও সেই আন্দোলনে রাজনীতি মিশতে দিতে রাজি ছিলেন না জুনিয়র চিকিৎসকেরা। ১৪ অগস্ট রাতে তাণ্ডবের পরেও ভয় পাননি তাঁরা। সেই সূত্র ধরে, রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সামগ্রিক পরিবর্তনের দাবিতে এক হয়েছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের চিকিৎসকেরা।

তবে সেখানেও ছিল সূক্ষ্ম রাজনীতি। শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বিশেষ গোষ্ঠী ‘উত্তরবঙ্গ লবি’ বনাম অন্য গোষ্ঠীর লড়াই। জুনিয়র চিকিৎসকেরা কখনওই কোনও বিশেষ লবির হয়ে উত্তরবঙ্গ লবির হুমকি প্রথা বা বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাননি। বরং নিজেদের মতো করে হুমকি প্রথার বিরুদ্ধাচারণ-সহ বেশ কিছু দাবি ছিনিয়ে আনতে পেরেছেন তাঁরা। তবে, এখন অনেকেই বলছেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ‘দাস’ত্ব মুক্তিতে শাসক দলের অপর গোষ্ঠী আজ কিছুটা হলেও সফল।

তার পরেও পূর্ণ কর্মবিরতি চালিয়ে যাওয়া, ফের অবস্থানের চিন্তাভাবনা কেন? যার জেরে পূর্ণ পরিষেবা পাচ্ছেন না গরিব মানুষ। ন্যায়বিচার ও নিজেদের ন্যায্য কিছু দাবি আদায়ে বদ্ধপরিকর জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের মধ্যেও ‘অন্য রাজনীতি’র অনুপ্রবেশ ক্রমশ চোখে লাগতে শুরু করেছে বলে মত অনেক সিনিয়র চিকিৎসকের। তাঁরা বলছেন, “কাজ বন্ধ করে রাস্তায় বসে থাকা কখনও আন্দোলন জিইয়ে রাখার সমার্থক হতে পারে না।” তাঁদের একাংশ এ-ও ইঙ্গিত দিচ্ছেন, জুনিয়র চিকিৎসকদের একটি অংশ কর্মবিরতি প্রত্যাহারের পক্ষে হলেও নানা সংগঠন ও বিভিন্ন হাসপাতালের ছাত্রগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাবনা তাতে বাদ সাধছে।

বিশ্লেষকদের মতে, মূল ধারার রাজনৈতিক শক্তিগুলির শাখা সংগঠন বা সমর্থক সংগঠন আন্দোলনকে হাতিয়ার করে নিজস্ব রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাব কষছে বলেই জটিলতা শুরু হয়েছে। অতি বাম ও বাম সংগঠনের সমর্থক চিকিৎসকদের একাংশ নিজেদের মতো করে একটি গোষ্ঠী তৈরি করে নিয়েছেন বলে মত অনেকেরই। আন্দোলনের বিপুল জনসমর্থনকে হাতিয়ার করে হারানো জমি পুনরুদ্ধারে তাঁরা কার্যত মরিয়া। যে হেতু আন্দোলনে নেতানেত্রীদের বড় অংশ সাধারণ ছাত্রছাত্রী, তাঁরা রাজনীতির মারপ্যাঁচ তত বোঝেন না। তাই, তাঁদের কাঁধে বন্দুক রেখে কেউ কেউ নিজস্ব রাজনৈতিক বা অন্য কোনও স্বার্থ পূরণ করছেন বলেই অনেকের ধারণা।

সিনিয়র চিকিৎসকদের একাংশ এ-ও ইঙ্গিত করেছেন, পিছন থেকে যাঁরা এই আন্দোলনকে কাজে লাগাতে চাইছেন, তাঁরা নিজেরা জীবনে প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের হারানোর কিছু নেই। এমনকি, শাসক দলের একাংশের তরফে এই আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টাও তাঁদের চোখে পড়েছে বলেই দাবি।

জুনিয়র চিকিৎসকদের অনেকেই বলছেন, তাঁদের দাবিগুলি সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই সেগুলি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত পিছপা হবেন না। কিন্তু আড়ালে থেকে রাজনৈতিক ‘পাশা খেলা’র জেরে সরকারি হাসপাতালে সাধারণ, গরিব মানুষের যথাযথ পরিষেবা পাওয়ার অধিকার কি তলিয়ে যাচ্ছে না? প্রশ্ন সেখানেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

R G Kar Hospital Doctor's Protest
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE