শাকসব্জির মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে টাস্ক ফোর্সের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল সোমবার। কিন্তু গত ক’দিনে আলুর দাম চড়চড় করে বেড়ে যাওয়ায় বৃহস্পতিবারই তড়িঘড়ি নবান্নে টাস্ক ফোর্সের বৈঠক ডাকলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে টাস্ক ফোর্সের সদস্যদের প্রবল ভর্ৎসনা করে বৈঠকটি কোনও রকমে শেষ করেই কৃষি এবং কৃষি বিপণন দফতরের দুই মন্ত্রী এবং প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের ডেকে নেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় মুখ্যমন্ত্রী এ দিন ফের স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, কোনও অবস্থাতেই আলু রাজ্যের বাইরে পাঠানো যাবে না এবং সরকারের বেঁধে দেওয়া ১৪ টাকা দরেই তা বিক্রি করতে হবে।
মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিলেও কী ভাবে ওই দামে আলু বিক্রি করা সম্ভব হবে, তার রূপরেখা অবশ্য তৈরি হয়নি এ দিনের বৈঠকে। সমাধান সূত্র খুঁজতে সন্ধের পরে কৃষি বিপণন দফতরের অফিসারেরা নিজেদের মধ্যে বৈঠকে বসলেও খুব একটা আশার আলো দেখা যায়নি বলেই নবান্ন সূত্রের খবর। বর্তমানে কলকাতা, লাগোয়া শহরতলি ও হাওড়ার ২৭টি পয়েন্টে কৃষি বিপণন দফতরের কর্মী-অফিসারেরা সরকারি দামে আলু বিক্রি করছেন। কিন্তু তাতে যে সংখ্যক মানুষ উপকৃত হচ্ছেন, তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। তাই আরও বেশি সংখ্যক পয়েন্টে ১৪ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রির নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সে কথা এ দিনই সমস্ত জেলা প্রশাসনকে জানিয়েও দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু সেই নির্দেশ কতটা বাস্তবায়িত করা যাবে, তা নিয়ে সংশয়ে নবান্নের কর্তারা। কারণ, ইতিমধ্যে একাধিক জেলার ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাঁরা যে পাইকারি দামে আলু কিনছেন, সেটাই ১৪ টাকার বেশি। ফলে খুচরো বিক্রির সময়ে তার দাম আরও বেড়ে যাচ্ছে। যেমন এ দিনই জেলাশাসকের সঙ্গে বৈঠকের পরে বর্ধমানের ফল ও সবজি ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক চন্দ্রবিজয় যাদব রীতিমতো প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছেন, তাঁদের পক্ষে কোনও ভাবেই সরকার নির্ধারিত দরে আলু বিক্রি সম্ভব নয়। কারণ তাঁরা ১৪ টাকার বেশি দামেই আলু কিনছেন। ব্যবসায়ীদের একটি সূত্রের বক্তব্য, কলকাতার এবং আশপাশের জেলাগুলির বাজারে এ দিনও জ্যোতি আলু বিক্রি হয়েছে ১৮-২০ টাকায়।
নবান্ন সূত্রের খবর, এ দিনের বৈঠকে প্রথমেই মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষোভের মুখে পড়েন টাস্ক ফোর্সের সদস্যরা। তাঁদের নজরদারি সত্ত্বেও কী ভাবে আলুর দাম বেড়ে চলেছে, তা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন মুখ্যমন্ত্রী। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের ভূমিকারও তীব্র সমালোচনা করেন তিনি। বৈঠকে উপস্থিত টাস্ক ফোর্সের একাধিক সদস্য জানান, মমতা কনফারেন্স রুমে ঢুকেই মাইক হাতে নিয়ে বলতে শুরু করেন, আপনারা আমার কথা রাখেননি। গত বৈঠকেই বলেছিলাম, ১৪ টাকা কিলো দরে আলু বিক্রি করবেন। আমার কথা অমান্য করে শুধু দাম ২২ টাকাই করলেন না, বাইরের রাজ্যেও পাঠাতে শুরু করলেন! আলুর দাম বাড়িয়ে মানুষকে ঠকালেন। এ বার আমি যা করার করব। ওই সদস্যরা বলেন, মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষুব্ধ হতে দেখে সকলে চুপ করে বসে ছিলেন। সেই সময় আলু ব্যবসায়ী গুরুপদ সিংহ কিছু বলতে চাইলে মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, আপনাদের কোনও কথা শুনব না। মেদিনীপুর দিয়ে আলু বেরিয়ে যাচ্ছে। ওখানকার ব্যবসায়ী সমিতিগুলোর উপর নজর রাখুন।
এটুকু বলেই টাস্ক ফোর্সের সদস্যদের দ্রুত চা-বিস্কুট খেয়ে নেওয়ার অনুরোধ করেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই পর্ব মিটতেই তাঁরা দ্রুত কনফারেন্স রুম থেকে বেরিয়ে যান। নবান্ন সূত্রের খবর, টাস্ক ফোর্সের সদস্যরা বেরিয়ে যাওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট দফতরের দুই মন্ত্রী এবং প্রশাসন ও দফতরের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে নবান্নের এক কর্তা বলেন, “টাস্ক ফোর্সের উপরে মুখ্যমন্ত্রী এতটাই বিরক্ত যে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কোনও আলোচনা করার প্রয়োজনই মনে করেননি।” কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু বা কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায় এ দিনের বৈঠক নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
পশ্চিমবঙ্গের মতো আলুর দাম বাড়ছে ঝাড়খণ্ডেও। সেখানকার ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গ থেকে কোনও ট্রাক না আসায় ক’দিনে আলুর দাম পাঁচ-ছ’টাকা বেড়েছে। ঝাড়খণ্ডের কৃষিসচিব নীতীন মদন কুলকার্নি এ দিন জানান, প্রতিবেশী রাজ্য যাতে আলু পাঠানো বন্ধ না করে, সেই অনুরোধ জানিয়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে চিঠি লিখছেন।
আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে টাস্ক ফোর্সের সদস্যদের ব্যর্থতা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নিজে ক্ষুব্ধ। কিন্তু এটা সব পক্ষেরই জানা যে, মূলত মজুতদারির জন্যই এ রাজ্যে আলুর দাম হু হু করে বাড়ছে। ব্যবসায়ী মহল এবং বাজার বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, গত মরসুমে ঝাড়খণ্ড, বিহার, অন্ধ্র এবং অসমে আলুর ধসা রোগ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য ফলন ভাল হয়নি। ফলে ওই সব রাজ্যে চাহিদা অনেকটাই বেড়েছে। পাশাপাশি ওই সব রাজ্য বরাবরই আলুর জন্য পশ্চিমবঙ্গের উপরে অনেকটাই নির্ভরশীল। এ বারে যে হেতু ওই সব রাজ্যে আলুর ফলন কম হয়েছে, তাই ওখানে আলু পাঠিয়ে বাড়তি মুনাফার আশায় রয়েছেন বহু ব্যবসায়ী। তাই চলছে মজুতদারি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভিন্ রাজ্যে আলু পাঠানোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় সেই মজুত করা আলু না এ রাজ্যের বাজারে আসছে, না ভিন্ রাজ্যে যাচ্ছে। ফলে এ রাজ্যের মতোই দ্রুত দাম বাড়ছে সেখানেও। ওই সমস্ত রাজ্যে আলুর দাম কিলোপ্রতি ৪ থেকে ৬ এমনকী ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। হুগলি, বর্ধমান-সহ বিভিন্ন জেলার আলু ব্যবসায়ীদের একাংশের অভিযোগ, আলুর মজুতদারির বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীর টাস্ক ফোর্সের বহু সদস্যই জানেন। এই সব মজুতদারই প্রতি বছর পুজোর আগে আলুর কৃত্রিম অভাব তৈরি করেন। ফলে এক দিকে যেমন মধ্যবিত্তের উপরে চাপ বাড়ে তেমনই বিড়ম্বনায় পড়ে রাজ্যও। এ বারও সে রকমই ঘটছে। এখনই রাশ টানা না গেলে পরিস্থিতি আরও হাতের বাইরে চলে যাবে বলেই সংশ্লিষ্ট সব মহলের মত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy