কাঁচরাপাড়ার জনসভায় মমতা। ছবি: টুইটার থেকে।
যে লাইন নিয়েছিলেন নৈহাটির ধর্নামঞ্চে দাঁড়িয়ে, দিন পনেরোর ব্যবধানে লাগোয়া কাঁচরাপাড়াতেও সেই লাইনই নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার দলীয় কর্মিসভায় তাঁর ভাষণের সিংহ ভাগ জুড়ে রইল বাঙালি-অবাঙালি টানাপড়েন। বার বার বললেন, ‘বাংলাকে গুজরাত হতে দেব না’। আর ‘বাংলায় থাকলে বাংলাটাও বলতে হবে’ বা ‘বাঙালিদের উপরে অত্যাচার করলে নিজেরাও কিন্তু ভাল থাকবেন না’ গোছের বেশ কিছু মন্তব্য করে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন যে, তিনি হুঁশিয়ারিই দিচ্ছেন।
ব্যারাকপুর-নৈহাটি শিল্পাঞ্চল জুড়ে তৃণমূল কর্মীদের উপরে অত্যাচার চলছে বলে অভিযোগ তুলে ৩০ মে নৈহাটি পুরসভার সামনে ধর্না তথা সত্যাগ্রহের আয়োজন করে তৃণমূল। সেই মঞ্চে দাঁড়িয়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন যে, বীজপুরেও সভা করবেন। সেই সভাই শুক্রবার হল এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন, উত্তর ২৪ পরগনার শিল্পাঞ্চলে হারানো জমি পুনরুদ্ধার করতে বাঙালি আবেগ জাগানোর চেষ্টা তিনি বার বারই করবেন।
আরও পড়ুন: সরকারের ‘মাল্টি অর্গান ফেলিওর’ হয়েছে, দায়ী মুখ্যমন্ত্রীর দম্ভ, তোপ বিজেপির
আরও পড়ুন: ডাক্তার নিগ্রহের প্রতিবাদে মিছিল শহরে, জনজোয়ারে শামিল বিদ্বজ্জনরাও
তিনি যখন বিহারে বা উত্তরপ্রদেশে যান, তখন তিনি হিন্দিতে কথা বলেন। যখন পঞ্জাবে বা তামিলনাডুতে যান, তখন সে সব রাজ্যের ভাষাতেও কয়েকটা কথা বলার চেষ্টা তিনি করেন। এই সব কথা বলতে বলতেই এ দিন বাঙালি-অবাঙালি প্রসঙ্গে ঢুকে পড়েন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে রাজ্যে থাকবেন, সে রাজ্যের ভাষাটাও বলতে হবে— মমতার বার্তা ছিল এই। তিনি বলেন, ‘‘বাংলায় থাকলে বাংলায় কথাটাও বলতে হবে। বাংলায় থাকব আর বাইকে করে এসে গুন্ডামি করে বাঙালিদের ভয় দেখিয়ে চলে যাব, এটা কিন্তু আমি বরদাস্ত করব না।’’ অবাঙালি বহুল শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার কথা উল্লেখ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন দাবি করেন, বাঙালিদের উপরে অত্যাচার চালানো হচ্ছে সেখানে। তাঁর কথায়, ‘‘কত বড় গদ্দার সব আর কত বড় গুন্ডার সর্দার, আমি দেখতে চাই। রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে বাঙালিদের বাড়িতে গিয়ে ভয় দেখিয়ে যাচ্ছে। কই আমি তো হিন্দিভাষীদের বাড়িতে ভয় দেখাতে যাইনি!’’ এর পরেই তৃণমূলনেত্রীর স্পষ্ট হুঁশিয়ারি, ‘‘যদি ভাবেন এই ভাবে ভাল থাকবেন, তা হলে জেনে নিন, নিজেরাও কিন্তু ভাল থাকবেন না।’’
বিজেপির বিরুদ্ধে এ দিন ফের বিভাজন ও বিদ্বেষমূলক রাজনীতির অভিযোগ তুলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপি কোথাও হিন্দু-মুসলিম, কোথাও বাঙালি-অবাঙালি, কোথাও বাঙালি-গোর্খা বিভাজন ঘটিয়ে ভোট জোগাড় করেছে বলে তাঁর দাবি। তার পরেই তৃণমূল চেয়ারপার্সন বলেন, ‘‘মহারাষ্ট্র থেকে বিহারীদের তাড়িয়েছে। গুজরাত থেকে তাড়িয়েছে। তাড়িয়েছে, কি তাড়ায়নি? বাংলা কিন্তু কোনও দিনও তাড়ায়নি।’’ কারও নাম না করে মমতার হুঁশিয়ারি, ‘‘ক্রিমিনালদের বলবেন, বেশি বাড়াবাড়ি না করতে। ...আমি চাই না আবার দুটো ভাগ হোক।’’
মুকুল রায়ের খাসতালুক কাঁচরাপাড়ায় কর্মিসভা করে তৃণমূলকর্মীদের এ দিন জবরদস্ত ভোকাল টনিক দেওয়ার চেষ্টা করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কখনও বলেন, ‘‘যদি বাংলার সভ্যতা, সংস্কৃতি, জাগরণ, মাটি, গঙ্গা, যমুনা, পদ্মা, তিস্তাকে ভালবাসেন, মনে রাখবেন মাথা নিচু করে চলা আমাদের কাজ নয়, মাথা উঁচু করে চলা আমাদের কাজ।’’ কখনও বলেন, ‘‘বাংলাকে গুজরাত বানাতে দেব না। এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে এগিয়ে আসুন। ভয় পাবেন না। ভয়ের কাছে মাথা নত করবেন না। আমি ভয়-টয় পাই না। ...আমি হাজার বিক্ষোভকারীদের মাঝখান দিয়েও হেঁটে যেতে পারি, কারণ আমি আন্দোলন করে বড় হয়েছি।’’ কখনও আবার বলেন, ‘‘আমাকে যদি কোথাও আঘাত কর, তা হলে কিন্তু আমি অপ্রতিরোধ্য। আমাকে আটকানোর ক্ষমতা তোমাদের কারও নেই।’’ বিরোধী পক্ষকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে তাঁর মন্তব্য, ‘‘ওরে এখনও দু’বছর এই সরকারটা আছে। তার পরে আবার পাঁচ বছরের জন্য আসবে। ২০১৬-য় জোট করেছিল। ঘোঁট বানিয়ে দিয়েছিলাম। আবার দেখিয়ে দেব।’’
সংবাদমাধ্যমকেও এ দিন নিশানা করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুদির দোকান বা মিষ্টির দোকানের মতো সংবাদমাধ্যমও ‘সংবাদের দোকান’, মন্তব্য মমতার। কোনও কোনও মিষ্টির দোকানে যেমন ভেজাল মিষ্টি মেলে, অনেক সংবাদমাধ্যমেও তেমন ‘ভেজাল সংবাদ’ মেলে— মন্তব্য তাঁর। তিনি আরও বলেন, সংবাদমাধ্যম যত গালাগালি দেয়, তাঁর ফলাফল ততই ভাল হয়। তাঁর কথায়, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোটিপতি ঘরের মেয়ে নন আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আঁতেল নন। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে গালাগালি দেওয়া সহজ।’’
কাঁচরাপাড়ার সভা থেকে আগামী দিনের আন্দোলনের রূপরেখাও ঘোষণা করে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইভিএম কারচুপি করে বিজেপি ক্ষমতায় ফিরেছে, এ তত্ত্বে তিনি এ দিনও অনড় থেকেছেন। আর সেই সূত্র ধরেই ঘোষণা করেছেন, ‘‘আগামী দিনে আমাদের লড়াই, ইভিএম চাই না, ব্যালট চাই। আমাদের গণতন্ত্র ফিরিয়ে দাও।’’
লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় বিজেপির উত্থানের পর থেকে তৃণমূলে ভাঙন ধরতে শুরু করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিনের কর্মিসভা থেকে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেন যে, ওই ভাঙনকে তিনি গুরুত্বই দিচ্ছেন না। তিনি বলেন, ‘‘যখনই কারও বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করব, তখনই অন্য দলে যাবে। যেতে দিন। আমি সাত দিন সময় দিলাম, যার যার যাওয়ার চলে যাও ভাই। পবিত্র হয়ে যাবে দলটা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy