টাউন হলে শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী। — নিজস্ব চিত্র।
একেই বিনিয়োগে হাঁড়ির হাল। তার উপর কেন্দ্রের পরীক্ষায় যাতে ফের নতুন করে মুখ না-পোড়ে, তা নিশ্চিত করতে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সেরে নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজ্যে ব্যবসা করার পথ আরও সহজ করার উপায় খুঁজতে সোমবার কলকাতায় টাউনহলে রাজ্যের সবকটি বণিকসভার সদস্য ও শিল্পপতিদের সঙ্গে ঘণ্টা দেড়েক বৈঠক করলেন মুখ্যমন্ত্রী। দাবি করলেন, জমির চরিত্র বদল থেকে শুরু করে ট্রেড লাইসেন্স— ব্যবসার প্রতি পদক্ষেপেই লাল ফিতের ফাঁস আলগা করতে সচেষ্ট হয়েছে তাঁর সরকার। চালু করেছে এক-জানলা পদ্ধতি। জানালেন পঞ্চায়েত আইন সংশোধনের কথা। যদিও এ সব সত্ত্বেও জমি-জট আর সিন্ডিকেট রাজের দৌরাত্ম্য এড়িয়ে এ রাজ্যে ব্যবসা করা কতটা সহজ হবে, তা নিয়ে সংশয়ী শিল্পমহলের একাংশ। বরং তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরেও লগ্নি টানার লক্ষ্যে ব্যবসা করার পথ সহজ করতে উদ্যোগী হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। কিন্তু তাতে চিঁড়ে তেমন ভেজেনি।
মার্চ মাসে কেন্দ্রীয় শিল্পনীতি ও উন্নয়ন দফতরের সচিব অমিতাভ কান্ত জানিয়েছিলেন, কোন রাজ্যে ব্যবসা করা কত সহজ, জুন-জুলাইয়ে তার মূল্যায়ন করবে কেন্দ্র। এ জন্য জমি পাওয়া ও তার চরিত্র বদলের সুবিধা, সেখানে নির্মাণ কাজ শুরুর ক্ষেত্রে মসৃণতা, বিদ্যুৎ সংযোগের মতো মোট ৯৮টি বিষয় খতিয়ে দেখা হবে। তার ভিত্তিতে তৈরি হবে রিপোর্ট কার্ড। জানানো হবে প্রতিটি রাজ্যের স্থান (র্যাঙ্কিং)। পরীক্ষায় ভাল করলে যেমন প্রশংসা মিলবে, তেমনই পিছিয়ে পড়লে ছি-ছি করতেও পিছপা হবে না কেন্দ্র। শিল্পমহলের অনেকেরই ধারণা, দিল্লির ওই পরীক্ষায় পিছিয়ে না-পড়তেই তড়িঘড়ি এ দিন আলোচনায় বসেছেন মমতা। মনে করিয়ে দিয়েছেন, ২০১১ সালে তাঁরা ক্ষমতায় আসার সময় সহজে ব্যবসা করার মাপকাঠিতে দেশে ১৭ নম্বরে ছিল পশ্চিমবঙ্গ। এ দিনের বৈঠকে রাজ্য অবশ্য এক বারের জন্যও কেন্দ্রের ওই পরীক্ষার কথা উল্লেখ করেনি।
অনেকে বলছেন, মুখ্যমন্ত্রী বিলক্ষণ জানেন যে, এ রাজ্যে বড় অঙ্কের লগ্নি বাড়ন্ত। তার উপর বিধানসভা ভোটের আগে কেন্দ্রের ওই তালিকায় পিছিয়ে পড়লে, শিল্প টানার ক্ষেত্রে তা কোনও ভাবেই তাঁর সরকারের পক্ষে ভাল বিজ্ঞাপন হবে না। তাঁদের মতে, সেই কারণেই রাজ্যে ব্যবসার পথ সহজ করার জন্য সরকারি উদ্যোগের খতিয়ান তুলে ধরতে এ দিন এত মরিয়া দেখিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে।
মমতার দাবি, ‘‘জমির চরিত্র বদল, পরিবেশ, দমকল, বিদ্যুতের মতো ৩৮টি বিষয়ে এক-জানলা ব্যবস্থায় ছাড়পত্র দেওয়া হবে। তার জন্য সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হয়েছে। দিন পনেরোর বেশি সময় কোথাও লাগবে না।’’ পণ্য-পরিষেবা কর জমা দেওয়া থেকে শুরু করে ট্রেড লাইসেন্স পাওয়া— অনেক কাজই অনলাইনে সেরে ফেলা যাবে বলে তাঁর দাবি।
নিজে ওই খতিয়ান দেওয়ার পাশাপাশি এ দিন মঞ্চে একে একে ভূমি ও ভূমি সংস্কার, বিদ্যুৎ, শিল্প, শ্রম, পরিবেশ, পঞ্চায়েত, অর্থ, নগরোন্নয়ন ও দমকল দফতরের সচিবদের ডেকে তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। জানতে চেয়েছেন প্রত্যেক দফতরের সুযোগ-সুবিধার হিসেব। জানিয়েছেন, পঞ্চায়েত আইন সংশোধনের কথা। যা অনুযায়ী, এ বার রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম, ওয়েবেল, রাজ্য ক্ষুদ্র শিল্পোন্নয়ন নিগমের মতো সংস্থাও তাদের শিল্পতালুকে প্রস্তাবিত বাড়ির নক্শা অনুমোদন করতে পারবে। মমতার দাবি, পঞ্চায়েত বা পুরসভার ছাড়পত্র তার জন্য লাগবে না। শিল্প দফতর সূত্রে দাবি, নিগমের মতো সংস্থাগুলি যাতে তাদের শিল্পতালুকে ‘বিল্ডিং প্ল্যান’ অনুমোদন করতে পারে, তার জন্য প্রযুক্তিবিদ রয়েছেন। প্রয়োজনে আরও ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ করা হতে পারে।
প্রত্যাশিত ভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে শিল্পমহল। বণিকসভা সিআইআইয়ের প্রেসিডেন্ট সুমিত মজুমদার বলেন, ‘‘যে সব পরিকল্পনার কথা মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। লগ্নি টানতে উদ্যোগী হচ্ছে রাজ্য।’’ তাঁর সঙ্গে একমত ভারত চেম্বারের ভাইস প্রেসিডেন্ট এন জি খেতান এবং এমসিসি চেম্বারের প্রেসিডেন্ট অরুণ সরাফও। তবে তাঁদের মতে, পুরো বিষয়টিরই সাফল্য নির্ভর করছে ওই সব পরিকল্পনার বাস্তবায়নের উপর। যেমন খেতানের দাবি, ছাড়পত্রের জন্য শুধু সময় বেঁধে দিলে হবে না। তার মধ্যে সায় না-মিললে, সেটি নীতিগত ভাবে অনুমোদিত (ডিমড অ্যাপ্রুভাল) হয়েছে বলে ধরে নেওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। সরাফের আবার অভিযোগ, জমির মিউটেশন হলেও সেটির চরিত্র বদল (কনভার্শন) সংক্রান্ত কাজ হচ্ছে না। ফলে মিলছে না রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট। আর যতক্ষণ তা না পাওয়া যাচ্ছে, নতুন শিল্পনীতি অনুযায়ী ততক্ষণ কোনও সুবিধা পাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট শিল্প। বিষয়টি সমাধানের জন্য মু্খ্যমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানান তিনি।
সহজে ব্যবসা করার পথ সুগম করতে পঞ্চায়েত মন্ত্রী তথা শ্রমিক সংগঠনের নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘শিল্প ক্ষেত্রে সংঘাত এড়াতে আমরা দলের পক্ষ থেকেও নির্দেশ দিয়েছি। একটি শিল্পে একটিই কর্মী সংগঠনের (ওয়ান ইন্ডাস্ট্রি-ওয়ান ইউনিয়ন) কথা বলা হয়েছে।’’ স্বাভাবিক ভাবে এই প্রতিশ্রুতিতেও খুশি রাজ্যের শিল্পমহল।
তবে রাজ্যে ব্যবসা করার পথ সুগম করতে মুখ্যমন্ত্রী যে এমনিই এমন মাথা ঘামাচ্ছেন, তেমনটা মনে করছেন না শিল্পপতিদের এক বড় অংশ। তাঁদের মতে, যে কোনও মূল্যে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পকে সফল করতে মরিয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু তা সফল হওয়ার প্রথম ও প্রধান শর্তই হল, দেশে বিনিয়োগ ও ব্যবসা করার পথ সহজ হওয়া। ফলে অন্তত এই বিষয়ে কোনও রাজ্যকে রেয়াত করবে না দিল্লি। বরং ক্রমাগত চাপ তৈরি করবে এ বিষয়ে পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলির উপর। বারবার তুলে ধরবে তাদের ব্যর্থতা। মুখ্যমন্ত্রী তা বিলক্ষণ জানেন।
এক শিল্পকর্তার কথায়, একেই এ রাজ্যে বড় লগ্নি প্রায় নেই বললেই চলে। তার উপর যদি দেখা যায় যে, ব্যবসা করার সুবিধার ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গ একেবারে পিছনের সারিতে, তাহলে রাজ্য সরকারের পক্ষে তা মোটেও ভাল বিজ্ঞাপন হবে না। প্রশ্ন উঠবে, মহারাষ্ট্র যেখানে বছরে ১০ লক্ষ কোটি টাকার লগ্নি প্রস্তাব সই করে ফেলতে পারে, সেখানে রাজ্যে বিনিয়োগ নেই কেন? কী কারণে এখানে ব্যবসার পথে এত প্রতিবন্ধকতা? ২০১৬ সালের ভোটের আগে এই সব প্রশ্নের মুখে পড়তে যে মমতা পছন্দ করবেন না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ দিনের সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অধিকাংশ স্থানীয় শিল্পপতিই। অনুপস্থিত ছিলেন সঞ্জীব গোয়েন্কা, হর্ষ নেওটিয়া, মহেন্দ্র জালান, উমেশ চৌধুরী। তবে এঁদের মধ্যে অধিকাংশ জনই কলকাতার বাইরে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy