Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
ডানার পরে নখেও কোপ

সংসদে ব্রাত্য মুকুলের ছায়া মাড়ানোই মানা

ডানা ছাঁটা আগেই হয়েছিল, মুকুল রায়কে এ বার কার্যত একঘরে করার বার্তা দিয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! দলে কোণঠাসা মুকুল বিজেপিতে যোগ দিতে পারেন বলে জল্পনা তুঙ্গে। সারদা কেলেঙ্কারিতে নাম উঠে আসায় মুকুলকে দলে নেওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে জোর তর্কও শুরু হয়েছে বিজেপির অন্দরে। এই অবস্থায় বৃহস্পতিবার তৃণমূল পরিষদীয় দলের বৈঠকে মমতা বললেন, দলে কোনও রকম অন্তর্ঘাত তিনি বরদাস্ত করবেন না। দলবিরোধী কাজ করলে কাউকেই ছাড়া হবে না। কারও নাম মমতা করেননি।

দু’জনে, দুই শহরে। কলকাতায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।  দিল্লিতে সাউথ অ্যাভিনিউয়ে নিজের বাড়িতে মুকুল রায়। বৃহস্পতিবার। ছবি: সুদীপ আচার্য, প্রেম সিংহ।

দু’জনে, দুই শহরে। কলকাতায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দিল্লিতে সাউথ অ্যাভিনিউয়ে নিজের বাড়িতে মুকুল রায়। বৃহস্পতিবার। ছবি: সুদীপ আচার্য, প্রেম সিংহ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা ও নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৪:০৫
Share: Save:

ডানা ছাঁটা আগেই হয়েছিল, মুকুল রায়কে এ বার কার্যত একঘরে করার বার্তা দিয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!

দলে কোণঠাসা মুকুল বিজেপিতে যোগ দিতে পারেন বলে জল্পনা তুঙ্গে। সারদা কেলেঙ্কারিতে নাম উঠে আসায় মুকুলকে দলে নেওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে জোর তর্কও শুরু হয়েছে বিজেপির অন্দরে। এই অবস্থায় বৃহস্পতিবার তৃণমূল পরিষদীয় দলের বৈঠকে মমতা বললেন, দলে কোনও রকম অন্তর্ঘাত তিনি বরদাস্ত করবেন না। দলবিরোধী কাজ করলে কাউকেই ছাড়া হবে না। কারও নাম মমতা করেননি। কিন্তু তাঁর মন্তব্যের লক্ষ্য যে মুকুলই, সে ব্যাপারে তৃণমূল নেতাদের মনে সন্দেহ নেই। যদিও মমতার মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মুকুলের জবাব, “আমি তৃণমূলের সঙ্গে আছি। অন্তর্ঘাত খুব খারাপ জিনিস। যারা অন্তর্ঘাত করে তারা ঘৃণ্য জীব।”

দলীয় সূত্রে বলা হচ্ছে, মুকুল প্রকাশ্যে যতই দলে থাকার কথা বলুন, মমতার সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়তে বাড়তে চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছে। মমতার জমানায় রেলের সংস্থা আইআরসিটিসি-র সঙ্গে সারদার চুক্তি নিয়ে বিতর্কের সময় দু’জনের সম্পর্কে চিড় ধরার সূত্রপাত। তার পর মুকুল কৌশলে ডেলোর বৈঠকের কথা কবুল করে নেওয়ায় মতান্তর বাড়ে। শেষমেশ বনগাঁ লোকসভা ও কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভার উপনির্বাচনের দিন মুকুল ও তাঁর ছেলের ভূমিকা নিয়ে দলীয় স্তরে অভিযোগের জেরে তা চূড়ান্ত আকার নেয়। দূরত্ব বাড়লেও মুকুলের ব্যাপারে এত দিন আস্তে-ধীরে চলছিলেন মমতা। তৃণমূলের সাংগঠনিক কর্ণধার দল ছাড়লে আঘাতের পরিমাণ কতটা হবে, তা নিয়ে সংশয় ছিল তাঁর মনে। কিন্তু উপনির্বাচনে জয় মমতাকে সাহস জুগিয়েছে। ফল প্রকাশের পরের দিনই মুকুলের ডানা ছাঁটার পরে আজ রীতিমতো হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেছেন, “আমরা যেমন কোমল হৃদয়ের, তেমনই কঠোর হৃদয়েরও।... আক্রমণ করতে এলে প্রয়োজনে বাঘের নখ উপড়ে আনতে পারি।”

এই প্রচ্ছন্ন হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি দলের নেতা-সাংসদদের মুকুলের ত্রিসীমানায় যেতেও মমতা বারণ করে দিয়েছেন বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। তিনি নিজেও মুকুলের সঙ্গে সব রকম সংস্রব এড়িয়ে চলার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে সাংসদ হিসেবে পাওয়া ফ্ল্যাটটি ছেড়ে দেওয়ায় দিল্লি এলে ১৮১, সাউথ অ্যাভিনিউয়ের বাংলোতে উঠতেন মমতা। বঙ্গভবনের চারতলায় বা সার্কুলার রোডের নতুন অতিথিশালায় তাঁর জন্য স্যুইট রেখে দেওয়া সত্ত্বেও। সাউথ অ্যাভিনিউয়ের বাংলোটি দলের পার্টি কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এটি এখনও মুকুল রায়ের নামেই বরাদ্দ রয়েছে। ওই বাড়িতে মমতার একটি আলমারি ও ঠাকুরের আসনের মতো সামান্য কিছু আসবাব রয়েছে। তৃণমূল সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই সেগুলি সরানোর কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। মমতা ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, তিনি আর ওই বাড়িতে থাকবেন না। সংসদের বাজেট অধিবেশন চলাকালীন দিল্লি আসার কথা রয়েছে মমতার। তৃণমূল সূত্র বলছে, রাজ্যসভার সাংসদ নাদিমুল হকের বাড়িতে উঠতে পারেন তিনি। কিংবা ১৮১-র পাশেই ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলোতে।

তৃণমূলে মুকুল-জমানা মুছে গিয়ে অভিষেক যুগ যে পাকাপাকি ভাবে এসে গিয়েছে, সে কথা বলছেন দলীয় নেতারাও। দলে ক্ষমতার স্তরবিন্যাসে অভিষেক মমতার ঠিক পরেই উঠে আসায় ব্রাত্য হয়ে পড়েছেন এত দিন দু’নম্বর থাকা মুকুল। যদিও তিনি নিজে এমন কোনও স্তরবিন্যাসের কথা অস্বীকার করে বলেছেন, “আমি কোনও দিনই দলে নম্বর টু ছিলাম না। তা ছাড়া, ক্ষমতা কেউ কাউকে দেয় না। অর্জন করে নিতে হয়। কংগ্রেসে রাহুলকে তুলে ধরতে গিয়ে মোটেই আহমেদ পটেলের (সনিয়া গাঁধীর রাজনৈতিক সচিব) ক্ষমতা খর্ব করা হয়নি।” তৃণমূলের অন্দরমহলে ‘যুবরাজ’ অভিষেকের সঙ্গে রাহুলের তুলনা এমনিতেই হয়। মুকুলও এত দিন ‘মমতার আহমেদ পটেল’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

কিন্তু মুকুলের তুলনাটা যে তৃণমূল শিবির ভাল ভাবে নেয়নি তা স্পষ্ট হয়ে যায় কলকাতায় অভিষেক এ নিয়ে মুখ খোলায়। তিনি বলেন, “কে রাহুল গাঁধী আর কে আহমেদ পটেল সেই ব্যক্তিগত তুলনায় যেতে চাই না। দলের এক জন বুথ কর্মী যে ভাবে প্রাণ দিয়ে দলটা করে, আমিও সেই রকম এক জন কর্মী, যিনি বাংলার মানুষের কাছে দায়বদ্ধ। এবং এই দলের সম্পদ দলের কর্মীরা। তারাই নেতা বানায়।”

তৃণমূল নেতাদের বড় অংশের বক্তব্য, দলের কাছে যে মুকুল রায় ব্রাত্য হয়ে গিয়েছেন সেটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। মুকুল সেটা না-বোঝায় ভান করলে তো সত্য পাল্টাবে না! দল যে তাঁকে আর চাইছে না, সেই বার্তা আরও স্পষ্ট করে দিয়ে সংসদের কাজকর্ম থেকেও সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে মুকুলকে। খাতায়কলমে তিনি এখনও তৃণমূল সংসদীয় দলের চেয়ারম্যান। কিন্তু সম্প্রতি কালীঘাটে দলীয় বৈঠকে মমতা সংসদের বিষয় দেখার নির্দেশ দিয়েছেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ডেরেক ও’ব্রায়েনকে। রবিবার স্পিকার সুমিত্রা মহাজনের ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে ওঁরা দু’জনই যাবেন। যদিও নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে সে দিন দিল্লিতেই থাকবেন মুকুল।

লোকসভায় তৃণমূলের দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় না হয় অসুস্থ থাকার কারণে যেতে পারবেন না, কিন্তু মুকুল যাবেন না কেন? মুকুলের যুক্তি, বৈঠক যে হেতু ডেকেছেন লোকসভার স্পিকার এবং তিনি রাজ্যসভায় তৃণমূলের দলনেতা, তাই তিনি যেতে পারেন না। তা হলে ডেরেক যাবেন কী করে? আর এই ধরনের অধিকাংশ বৈঠকে সিপিএমের হয়ে সংসদীয় দলনেতা সীতারাম ইয়েচুরি উপস্থিত থাকেন। ঘটনাচক্রে তিনিও তো রাজ্যসভার সাংসদ। মুকুল জবাব এড়ালেও তৃণমূল নেতারা বলছেন, বিজেপির দিকে ঝুঁকে থাকা মুকুলকে সব দিক থেকেই ছেঁটে ফেলার সিদ্ধান্ত যে মমতা নিয়ে ফেলেছেন, এই ঘটনাই তার প্রমাণ। ওই নেতাদের মতে, মমতা চাইছেন মুকুল নিজে থেকেই দল ও সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিন। তাতে অন্তত প্রকাশ্য তিক্ততা এড়ানো যাবে।

শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁকে ঠেলতে ঠেলতে খাদের কিনারায় এনে ফেললেও প্রকাশ্যে এখনও মচকাননি মুকুল। দায়িত্ব ছাঁটা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, “এ রকম তো হয়েই থাকে। এ ধরনের ঘটনা জীবনের অঙ্গ।” পাশাপাশি সাংগঠনিক রদবদলকে ‘স্বাগত’ জানিয়ে বলেছেন, “দল বড় হচ্ছে। রাজ্যে ক্ষমতায়। সংসদেও দলের শক্তি অনেক বেড়েছে। যাঁরা নতুন দায়িত্বে পেলেন আমি আশা করব তাঁদের নেতৃত্বে দল গোটা দেশে ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হবে।” যে মন্তব্যের পিছনে চ্যালেঞ্জের বার্তাও দেখছেন অনেকে। তাঁদের মতে মুকুল আসলে বলতে চাইছেন, শূন্য থেকে শুরু করে আজ দলকে এই জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার পিছনে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। এ বার অন্যরা যোগ্যতা প্রমাণ করে দেখান।

মুকুলের সাংগঠনিক দক্ষতার কারণেই বিজেপির একটি অংশ তাঁকে এখনই দলে নিতে আগ্রহী। ওই নেতাদের মতে, আসন্ন পুরসভা ভোটে ভাল ফল হলে মমতা সময়ের আগেই বিধানসভা ভেঙে দিয়ে ভোটে চলে

যেতে পারেন। তখন সংগঠনহীন রাজ্য বিজেপির পক্ষে কোনও ভাবেই তৃণমূলের মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। মুকুলকে দলে নিলে সেই সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়ে যাবে। যদিও বিজেপির অন্য অংশের বক্তব্য, সারদা কেলেঙ্কারিতে মুকুলের নাম উঠে আসায় তিনি পুরোপুরি ছাড় না-পাওয়া পর্যন্ত তাঁকে দলে নেওয়া উচিত নয়।

মুকুলকে নিয়ে বিজেপির এই দোলাচলের কথা মমতা বিলক্ষণ জানেন। এটাও জানেন যে, মধ্যবর্তী ব্যবস্থা হিসেবে মুকুলের নেতৃত্বে তৃণমূল ভাঙার জল্পনাও চলছে। তারই পাল্টা হিসেবে এক দিকে তিনি যেমন শুভেন্দু অধিকারী, দীনেশ ত্রিবেদীর মতো বিক্ষুব্ধ নেতাদের বাড়তি দায়িত্ব দিয়ে কাছে টানার চেষ্টা করেছেন, তেমনই একঘরে করে দিতে চাইছেন খোদ মুকুলকে।

অন্য বিষয়গুলি:

mukul roy mamata banerjee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy