Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

বড় বিনিয়োগ কপালে নেই, ছোট চমক রিয়েলিটি শোয়ে

শিল্পের পরিবেশ নেই। পরিবেশ তৈরির কোনও উদ্যোগও নেই। তবু বিনিয়োগ টানার নামে ফের চমকের পথেই হাঁটলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবার ফেসবুক-এ মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা, একটি বাংলা টিভি চ্যানেলে ‘বিজনেস রিয়েলিটি শো’ করবে তাঁর সরকার।

ফেসবুকে এই ছবিটিই পোস্ট করে ‘এগিয়ে বাংলা’ শোয়ের ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

ফেসবুকে এই ছবিটিই পোস্ট করে ‘এগিয়ে বাংলা’ শোয়ের ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৩২
Share: Save:

শিল্পের পরিবেশ নেই। পরিবেশ তৈরির কোনও উদ্যোগও নেই। তবু বিনিয়োগ টানার নামে ফের চমকের পথেই হাঁটলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

রবিবার ফেসবুক-এ মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা, একটি বাংলা টিভি চ্যানেলে ‘বিজনেস রিয়েলিটি শো’ করবে তাঁর সরকার। ‘এগিয়ে বাংলা’ নামে ওই শো সঞ্চালনা করবেন প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। সেখানে হাজির হয়ে রাজ্যের সফল তরুণ শিল্পপতিরা তাঁদের কাহিনি শোনাবেন। তাঁদের এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন সফল করতে যা যা প্রয়োজন— সরকার সে ব্যাপারে সাহায্য করবে। মমতার রিয়েলিটি শো নিয়ে সোমবার দিল্লিতে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের প্রতিক্রিয়া, ‘‘সেটা একটা দুর্দান্ত জিনিস হবে। ভয়ঙ্কর একটা... মানুষের অনুভূতি, কী আকাঙ্ক্ষা, কী বক্তব্য, রিয়েলিটি শোয়ের মাধ্যমে তিনি নিজে নিয়ে আসবেন। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী নিজে খসড়া করছেন।’’

কেন এই ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর?

নবান্নের শীর্ষ মহলের মতে, গত বিধানসভা ভোটের আগে নির্বাচনী ইস্তেহারে রাজ্যের শিল্প নিয়ে অনেক আশার কথা শুনিয়েছিলেন মমতা। সিঙ্গুরে ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের ৪০০ একর জমি ফিরিয়ে বাকি জমিতে নতুন বিনিয়োগ, শিল্প-পরিকাঠামো গড়ে তোলা ও শিল্পবান্ধব পরিবেশ তৈরির ঘোষণাও ছিল তখন। কিন্তু আরও একটি ভোটের মুখে এসে দেখা যাচ্ছে, প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবের যোজন দূরত্ব। তাঁর আমলে নতুন কোনও বড় বিনিয়োগ আসেনি। চার বছর ধরে মমতার সরকার যে সব তথ্য দিচ্ছে, তাতেও বাস্তবের সঙ্গে বেমানান। মাঝারি ও ছোট শিল্পের ক্ষেত্রেও প্রচারই সর্বস্ব। এই পরিপ্রেক্ষিতে সামনের বছরের ভোটের কথা মাথায় রেখে সরকার এমন কিছু করতে চাইছিল, যাতে চমক দেওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক ফায়দাও মেলে। তাই বাঙালির অন্যতম সেরা ‘আইকন’ সৌরভের হাত ধরে রিয়েলিটি শোয়ের আয়োজন, মুখ্যমন্ত্রীর নিজের কথায় যা, ‘এই প্রথম’।

কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা খরচ করে আরও একটি চমকপ্রদ ঘোষণার প্রত্যাশিত ভাবেই সমালোচনা করেছে বিরোধীরা। সিপিএম পলিটব্যুরোর সদস্য মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘শোয়ের বিষয় না জেনে স্পষ্ট করে কিছু বলা মুশকিল। তবে মনে হচ্ছে গিমিক ছাড়া বিশেষ কিছু হবে না।’’

জাতীয় স্তরের বণিকসভার এক কর্তার মতে, এই ‘রিয়েলিটি শো’ রাজ্যের বেড়া টপকাতে পারবে না। তাঁর কথায়, ‘‘এই অনুষ্ঠান রাজ্যের মধ্যে সাড়া জাগাতে পারে। কিন্তু সময় খরচ করে জাতীয় স্তরের শিল্পপতিরা কেন আসবেন? বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে এ ধরনের অনুষ্ঠানে যোগদান করা লাভজনক। কারণ তাতে প্রচার হয়। কিন্তু জাতীয় স্তরের বিনিয়োগকারী টানার জন্য এই ধরনের অনুষ্ঠানের সার্থকতা নেই বললেই চলে।’’ একই মত সেলিমের। এবং সেই সূত্রে তাঁর কটাক্ষ, ‘‘বিশ্ববাংলা ঘুরে এখন বাংলার পাড়ায় নেমে আসতে হল!’’

উৎপাদন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত এক কর্তারও দাবি, এই ‘শো’ মূলত স্থানীয় শিল্পপতি ও বিনিয়োগকারীদের মুখ দেখানোর জায়গা হবে। কারণ সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দিলে সিন্ডিকেটের দাদাগিরি সামলানো সহজ হবে বলে ভাবতে পারেন অনেকেই। ফলে সব মিলিয়ে এই শোয়ে ছোট শিল্পের কথাই বলা হবে বলে মনে হয়। সেলিমের পর্যালোচনা, ‘‘ছোট শিল্প খুব ভাল জিনিস। কিন্তু বড় শিল্প ছাড়া তাদের টিকিয়ে রাখা মুশকিল। বাংলায় বড় শিল্প কোথায়? সিঙ্গুরের সঙ্গে সঙ্গেই সেই সুযোগ নষ্ট হয়েছে।’’ বিজেপি-বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘রাজ্য সরকার সিঙ্গাপুর বা লন্ডন থেকে একটা মিসড কল (ব্যবসায়ীদের থেকে) পর্যন্ত পায়নি। এখন ছোট শিল্পের কথা বলছে। কিন্তু ছোট শিল্প কী ভাবে করতে হয়, সম্প্রতি অমিত মিত্রকে পাশে বসিয়ে তা বলে গিয়েছেন অরুণ জেটলি।’’

কিন্তু তার পরেও বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এই অনুষ্ঠান কতটা কার্যকর হবে, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কারণ লগ্নি করার জন্য সঠিক পরিবেশ খুঁজবেন বিনিয়োগকারী। কোনও রিয়েলিটি শো সেই আস্থা জোগাতে পারে না বলেই মনে করেন শিল্পকর্তারা।

কিন্তু এমন পরিস্থিতি হল কেন?

রাজ্যের একাধিক বণিকসভার মতে, উত্তরটা লুকিয়ে রয়েছে সরকারের নীতি ও ভাবমূর্তির মধ্যেই। তাদের ব্যাখ্যা, শিল্পের জন্য এই সরকার জমি অধিগ্রহণ করবে না। সরকারের পরামর্শ হল, বিনিয়োগকারীরা জমি কিনে শিল্প গড়ুক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের জমি যেখানে বহু মালিকানায় বিভক্ত, সেখানে কোনও সংস্থার পক্ষে সেটা করা কার্যত অসম্ভব। তা ছাড়া, জমি কিনতে গিয়ে শাসক দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের দৌরাত্ম্যের মুখোমুখি হতে হচ্ছে দেখেও সরকার কার্যত কোনও ভূমিকা নেয়নি। সিন্ডিকেটরাজ ও তোলাবাজি রাজ্যে শিল্প গড়ার অন্যতম অন্তরায় বলেই মনে করে প্রশাসনের একাংশ। তাঁদের কথায়, ‘‘নতুন গড়া তো দূরের কথা, শাসক দলের বিভিন্ন গোষ্ঠীর তোলাবাজির দাপটে অনেকে মাঝপথে পাততাড়ি গুটিয়েছে।’’

বিরূপ ভাবমূর্তির কারণে সরকারের শিল্প পার্কেও কেউ বিনিয়োগ করতে রাজি নয়। শিল্প দফতরের খবর, রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের অধীনে যে ২২টি শিল্প পার্ক রয়েছে, বারবার বিজ্ঞাপন দিয়ে সেখানে বিনিয়োগকারী পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারের একটি অংশের অবশ্য দাবি, বিনিয়োগ টানতে ভূমি আইনের ১৪ ওয়াই ধারায় ছাড় দিয়ে বহু ক্ষেত্রে সিলিং-অতিরিক্ত জমি রেখে শিল্প করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, শিল্পের জন্য আবেদন করার নিয়ম ও পদ্ধতি অনেক সরল করা হয়েছে। কিন্তু শিল্প টানার জন্য মূল যে জায়গায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন, সেই জমি নীতি নিয়েই অনড় মমতা। ফলে ছবিটা কিছুতেই পাল্টাচ্ছে না।

লগ্নি টানতে সপার্ষদ সিঙ্গাপুর, লন্ডন এবং মুম্বই সফর করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তা ছাড়া, তৃণমূল সরকারের প্রথম দু’বছরে কলকাতা ও হলদিয়ায় ‘বেঙ্গল লিডস’ নামে শিল্প সম্মেলন হয়েছিল। কোনওটাতেই রাজ্যের বাইরের কোনও নামজাদা শিল্পপতি যোগ দেননি। লগ্নির প্রশ্নেও তেমন আশ্বাস মেলেনি। এর পর ২০১৩ সালের অগস্টে মুম্বইয়ে শিল্প সম্মেলন করেন মমতা। সেখানে হাজির ছিলেন রিলায়্যান্স গোষ্ঠীর মুকেশ অম্বানী। আলাদা করে তাঁর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকও হয়েছিল। কিন্তু এ রাজ্যে রিলায়্যান্স গোষ্ঠীর ফোর-জি ছাড়া আর কোনও বিনিয়োগ আসেনি।

মুম্বই সম্মেলনের ঠিক এক বছরের মাথায় গত বছর অগস্টে সিঙ্গাপুর যান মুখ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী তথা শিল্পমন্ত্রী। পাঁচ দিনের সফরে ১৩টি ‘মউ’ হয়েছিল। এর একটিও বাস্তবায়িত হয়েছে বলে এখনও সরকারই দাবি করেনি, জানায়নি বিনিয়োগের অঙ্কও।

চলতি বছরের গোড়ায় সল্টলেক স্টেডিয়ামে যে ‘বিশ্ববঙ্গ শিল্প সম্মেলন’-এর আসর বসেছিল, সেখানে ২ লক্ষ ৪৩ হাজার কোটি টাকার লগ্নি প্রস্তাবের কথা ঘোষণা করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। সরকারি তথ্য বলছে, এর মধ্যে ১ লক্ষ ১২ হাজার কোটি লগ্নি আসার কথা বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্প থেকে। এবং এর কোনওটাই নতুন নয়, বেশ কয়েক বছর ধরে চালু রয়েছে রাজ্যে।

মুখ্যমন্ত্রীর শেষ সফর ছিল লন্ডন। সেই সফরে ২২টি ‘মউ’ সই হয়েছে। কিন্তু সেখানেও বিনিয়োগের পরিমাণ কত, তা সরকারি ভাবে এখনও জানানো হয়নি। সফরের পর মাস দুই কেটে গেলেও ২২টি মউ-এর পরিণতি কী হল, তা-ও জানাতে পারেনি শিল্প দফতর।

রাজ্যে বিনিয়োগের আভাস দিতে ২০১৫-’১৬ সালের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ২০১১ সালের মে মাস থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজ্যে ৮৪ হাজার ২১১ কোটি টাকার লগ্নি হয়েছে বা হওয়ার পথে। গত চার বছরে শিল্প প্রস্তাব এসেছে মোট ৫৫ হাজার কোটি টাকার।

যদিও কেন্দ্রের ডিপার্টমেন্ট অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল পলিসি অ্যান্ড প্রমোশন (ডিআইপিপি) ২০১৫ সালের জুলাইয়ে যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০১২ সালে রাজ্যে ৯১টি শিল্প স্থাপনের জন্য ৫৮৬৯ কোটি, ২০১৩ সালে ৮৭টি শিল্পের জন্য ৮০৫৪ কোটি, ২০১৪ সালে ৬০টি প্রকল্পের জন্য ২৭৭৪ কোটি এবং ২০১৫ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত ৫৩টি শিল্পের জন্য ১৬ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকার প্রস্তাব এসেছে। কেন্দ্রীয় এই সংস্থা থেকেই নতুন বিনিয়োগের অনুমোদন নিতে হয়।

নবান্নের একাংশের মতে, রাজ্যে শিল্পের বন্ধ্যত্ব নিয়ে ক্রমেই উদ্বেগ ঘনাচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর মনে। তিনি জানেন, অবিলম্বে কিছু কর্মসংস্থান না করতে পারলে ভোটের ময়দানে বিপাকে পড়তে হবে তাঁকে। তাই বড় শিল্প না-হোক স্থানীয়দের হাত ধরে ছোটখাটো ব্যবসা বাড়াতে আগ্রহী তিনি। কিন্তু ঘটনা হল, বড় শিল্প না-এলে ছোট শিল্পেরও বিকাশ হয় না। ফলে রিয়েলিটি শোয়ের চমক তৃণমূলকে রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড দিতে পারে, রাজ্যের শিল্পচিত্রকে উজ্জ্বল করতে পারবে না।

এই সংক্রান্ত আরও খবর:

করের টাকা খরচ করে কেন রিয়েলিটি শো, উঠছে প্রশ্ন

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE