তাঁর সরকার জমি দিতে না পারায় ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সংস্কারের কাজ থমকে রয়েছে বলে বারবার অভিযোগ করেছে কেন্দ্র। কিন্তু সড়কের বেহাল দশার জন্য ফের কেন্দ্রের দিকেই আঙুল তুলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুঁশিয়ারি, “৩ বছর ধরে জাতীয় সড়ক মেরামতির জন্য বলছি। কথা না শুনলে কী ভাবে শোনাতে হয়, আমি জানি!”
উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদহে প্রশাসনিক বৈঠক করার জন্য সোমবার রাতে সড়কপথে কলকাতা থেকে রায়গঞ্জ পৌঁছন মমতা। যদিও তাঁর যাওয়ার কথা ছিল ট্রেনে। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে তা বাতিল করে গাড়িতে রায়গঞ্জের উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে তাঁর কতটা কষ্ট হয়েছে, কত বার তিনি দুর্ঘটনার কবলে পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছেন, এ দিন তিন জেলার আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠকে সে কথা জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। বৈঠকে হাজির রাজ্য পুর্ত দফতরের অফিসারদের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ, “আপনারা ট্রেনের বদলে সড়কপথে কলকাতায় যাবেন। জাতীয় সড়কের হাল সরেজমিনে দেখে আমাকে রিপোর্ট দেবেন।” বৈঠকের মাঝে গঙ্গারামপুর স্টেডিয়ামে এক প্রশাসনিক জনসভায় কেন্দ্রকে কটাক্ষ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আচ্ছা দিন আয়েগা! আ গয়ে বুরে দিন! জাতীয় সড়ক দিয়ে দিন। আমরা দেখে নেব।” তাঁর অভিযোগ, “আমি তিন বছর ধরে লাগাতার বলে চলেছি। মুখ্যসচিবও রাস্তা করার জন্য এনএইচএআইকে বারবার বলেছেন। পূর্ত দফতরের মন্ত্রী-সচিবেরাও বলছেন। কিন্তু ওরা জাতীয় সড়কের কাজ করছে না।” যদিও জেলা প্রশাসনের আধিকারিকরা জানাচ্ছেন, মুখ্যমন্ত্রীর যাত্রাপথের অনেকটা জুড়েই ছিল রাজ্য সড়ক। জাতীয় সড়কের মতো তারও বিরাট অংশের দশা শোচনীয়। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এই নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেননি।
মুখ্যমন্ত্রী উষ্মা প্রকাশ করলেও কেন্দ্রের অভিযোগ, জাতীয় সড়কের সম্প্রসারণের জন্য জমি অধিগ্রহণ এবং রাস্তার পাশের জমিতে জবরদখল উচ্ছেদের ব্যাপারে রাজ্য হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে। ফলে সড়ক সংস্কারের কাজ থমকে আছে। এ নিয়ে গত মাসেই মমতাকে চিঠি লিখে সমস্যার সমাধান চেয়েছেন কেন্দ্রীয় সড়ক ও ভূতল পরিবহণ মন্ত্রী নিতিন গডকড়ী। সম্প্রতি দিল্লিতে তিনি বলেন, “জমি অধিগ্রহণ ও আইন-শৃঙ্খলা রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয়। এ ব্যাপারে রাজ্য এগোলে কেন্দ্রের তরফে সহযোগিতায় ত্রুটি হবে না। এ কথা পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের সাংসদদের জানানো হয়েছে।” মন্ত্রী যে দিন এ কথা বলেন, তার ক’দিন আগেই তৃণমূলের সংসদীয় প্রতিনিধি দল তাঁর সঙ্গে দেখা করে জাতীয় সড়কের বেহাল দশা নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছিলেন।
কেন্দ্রের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের অভিযোগ নিয়ে প্রশাসনের অন্দরেই প্রশ্ন উঠেছে। নবান্নের একটি অংশের বক্তব্য, নতুন সরকারের জমিনীতির ফলে রাজ্যে এখন এক ছটাক জমি পাওয়াও কঠিন। শুধু জাতীয় সড়ক নয়, জমির অভাবে আটকে রয়েছে শিল্প থেকে বাঁধ নির্মাণ, রেলের প্রকল্প থেকে কৃষক বাজার তৈরির কাজ। একটি সাব-স্টেশন তৈরি করতে যে দু’তিন একর জমি লাগে, তা-ও মিলছে না বলে এ দিনই কলকাতায় অভিযোগ করেছেন রাজ্য সরকারেরই এক বিদ্যুৎ সংস্থার পদস্থ কর্তা।
কিন্তু জমি জটে রাস্তার সম্প্রসারণের সঙ্গে তার বেহাল দশার কী সম্পর্ক? সাধারণ মেরামতি করেও যখন রাস্তার খানাখন্দ বোজানো যায়, তখন জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ সেটাই বা করেন না কেন? এ প্রশ্নের জবাবে সড়ক নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ইঞ্জিনিয়ার ও আধিকারিকদের বক্তব্য, ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের যা হাল, তাতে মেরামত (প্যাচ ওয়ার্ক) করে খুব লাভ হবে না। দরকার এর সম্প্রসারণ। কারণ, এই সড়ক যখন তৈরি হয়েছিল, তখন এর উপর দিয়ে যে সংখ্যক গাড়ি যাওয়ার হিসেব করা হয়েছিল, এখন তার প্রায় তিন গুণ বেশি গাড়ি যায়। এখন রাস্তা চওড়া না করা গেলে সাধারণ নিয়মেই তার উপরে গাড়ির ভার (লোড) ছড়িয়ে পড়ার (ডিস্ট্রিবিউট) সুযোগ পায় না। ফলে তার ভাঙন ঠেকানোর কোনও উপায়ও থাকে না। তখন প্যাচ ওয়ার্ক করা মানে স্রেফ টাকা নষ্ট। সে কারণেই ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের সম্প্রসারণের উপর এত বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে।
৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সংস্কারের কাজ যে তিন বছর ধরে আটকে রয়েছে, তা নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য দু’পক্ষই একমত। গডকড়ী জানিয়েছিলেন, ইস্ট-ওয়েস্ট করিডর, ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের সম্প্রসারণ, বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণ-সহ প্রতিটি প্রকল্প ধরে ধরে তাঁর সঙ্গে রাজ্যের পূর্তকর্তাদের কথা হয়েছে। দেখা গিয়েছে, প্রতি ক্ষেত্রেই সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি রয়েছে রাজ্যেরই হাতে। মুখ্যমন্ত্রীকে গডকড়ী লিখেছিলেন, “পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় সড়ক নির্মাণের বিভিন্ন প্রকল্প সাত থেকে দশ বছর ধরে আটকে রয়েছে। এ ব্যাপারে মূল সমস্যা দুটি জমি অধিগ্রহণ ও রাস্তার পাশের জবরদখল উচ্ছেদ। আমি চাই, আপনি গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখুন। রাজ্য সহযোগিতা করলে কেন্দ্র দু’হাত বাড়িয়ে পরিকাঠামো নির্মাণ করবে। রাজ্যকে এ জন্য টাকার চিন্তা করতে হবে না।”
এ দিন মালদহ কলেজের অডিটোরিয়ামে গত কাল রাতের সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে মমতা বলেন, “কাল আমার গাড়ি জাতীয় সড়কে চার বার দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচেছে! ছোট গাড়ি বলে বেঁচে গিয়েছি। বড় গাড়ির কথা তা হলে ভাবুন!” গঙ্গারামপুরে তাঁর হুঙ্কার, “সরকারে আছি বলে আন্দোলন ভুলে গিয়েছি ভাবলে ভুল করা হবে। কৃষিজমি রক্ষায় আমি ২৬ দিন অনশনে বসেছিলাম। আন্দোলন লগ্নে আমার জন্ম। আন্দোলন করে এক দিন আমার মৃত্যু হবে।” এর পরেই তাঁর সংযোজন, “৪৬ জন সংসদে রয়েছি। জাতীয় সড়কে কাজ না হলে আন্দোলন হবে। পার্টির জন্য নয়, জনগণের জন্য।”
মুখ্যমন্ত্রী পরে সাংবাদিকদের বলেন, “আজ এখানে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষকে বলেছি, আমরা খুব বিরক্ত। এনএইচআই রাস্তাগুলি করছে না বলে লোকের খুব কষ্ট হচ্ছে।” একই সঙ্গে তাঁর ক্ষোভ, “আগে তা-ও জাতীয় সড়ক ‘প্যাচ ওয়ার্ক’ করত। এখন তাও করছে না!” জাতীয় সড়ক কত দিনের মধ্যে মেরামত করতে বলেছেন? এ প্রশ্নের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমরা ইমিডিয়েটলি করতে বলেছি। ওদের অভিধানে ইমিডিয়েট মানে একদিন না কত দিন, কী করে বলব!”
৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের বেহাল দশা নিয়ে গত কালই জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের কাছে হলফনামা চেয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy