বৃহস্পতিবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র।
দিদি প্রধানমন্ত্রী না হলে ঘাটালের নিস্তার নেই। দিদি প্রধানমন্ত্রী না হলে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান কার্যকর হবে না। বুধবার পশ্চিম মেদিনীপুরের জলমগ্ন ঘাটালে দাঁড়িয়ে এমনই বলেছিলেন অভিনেতা-সাংসদ দেব। বলেছিলেন, ‘‘দিদি যত দিন না প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, তত দিন ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণের কোনও সম্ভাবনাই নেই। তাই দিদিকে প্রধানমন্ত্রী করতেই হবে।’’
এটি একটি নমুনা মাত্র। ‘কঠিন’ ভোটে বিজেপি-কে জমি ধরিয়েতৃতীয় বার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগামী দিনে দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন— এমন আশাবাদ তৃণমূলের ছোট-বড় সব নেতার কথায়। শুধু আশাবাদই নয়, সেই মর্মে ফেসবুক-টুইটার-ইনস্টাগ্রামে প্রচারও শুরু হয়ে গিয়েছে। বাঁধা হচ্ছে লিমেরিক। ছড়িয়ে যাচ্ছে দু-চার লাইনের ছড়া। শুধু পশ্চিমবঙ্গই নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তৃণমূলের অফিস খোলা হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশে পোস্টার পড়ছে, স্লোগান উঠছে ‘দিদি আ রহি হ্যায়’। বামশাসিত কেরলের রাস্তায় মমতার ছবি দিয়ে হোর্ডিং পড়ছে ‘কল দিদি, সেভ ইন্ডিয়া’। মমতা নিজেও সম্প্রতি দিল্লি সফরে গিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে জোটের কথা বলেছেন। যদিও তার মধ্যেই তিনি দেখা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে। কিন্তু ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে সেই মমতাকেই মোদীর বিরুদ্ধে ‘মুখ’ হিসেবে তুলে ধরছে তৃণমূল। মমতা অবশ্য একটিবারও নিজেকে ‘মুখ’ মানতে রাজি হননি। প্রশ্নের উত্তরে কখনও বলেছেন, ‘‘আমি লিডার নই, ক্যাডার।’’ আবার কখনও বলেছেন, ‘‘আমি জ্যোতিষী নই। তাই কে মুখ হবেন বলতে পারব না। আমি জোটের একজন কর্মী হিসেবে কাজ করতে চাই।’’
বুধবার ঘাটালে দেব যখন দিদিকে প্রধানমন্ত্রী করার কথা বলছেন, ‘দিদি’ তখন হাওড়ার আমতায় বন্যার জলে দাঁড়িয়ে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বরাবরের মতো এ বারেও জলে নেমেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে উপরে ওঠার পথও যে তৈরি হচ্ছে, তার নজির দেখা গেল বৃহস্পতিবার। নবান্নেনোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অনেকের সঙ্গে প্রথমে বৈঠক ও পরে তাঁদের নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করলেন মমতা। বিষয় ছিল রাজ্যের করোনা নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর আসনের প্রেক্ষাপটে দেখা গেল জাতীয় পতাকা। মমতার আসনের দু’পাশে দু’টি করে জাতীয় পতাকা। যা সাধারণত দেখা যায় রাষ্ট্রনায়কদের ক্ষেত্রে। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতিদের ক্ষেত্রে বা কোনও দেশের রাষ্ট্রনেতাদের ঘরে সংশ্লিষ্ট দেশের জাতীয় পতাকার অবস্থান এমনই থাকে। মমতার টেবিলেও ছিল জাতীয় পতাকা। তা আগেও দেখা গিয়েছে। কিন্তু মমতার আসনের দু’পাশে জাতীয় পতাকার এমন অবস্থান আগে দেখা গিয়েছে বলে সরকারি আধিকারিকদের কেউ মনে করতে পারছেন না।
কেন এ ভাবে মমতার ঘর সাজানো হয়েছে তা নিয়ে কোনও ব্যাখ্যা নবান্ন বা তৃণমূল সূত্রে পাওয়া যায়নি। কেন জাতীয় পতাকা, তার একটা ব্যাখ্যা অবশ্য মমতার পরিচিতেরা দিচ্ছেন। তবে তা ‘সরকারি’ বা ‘আনুষ্ঠানিক’ নয়। তাঁদের বক্তব্য, অভিজিৎ বিনায়কের মতো একজন ‘আন্তর্জাতিক’ স্তরের মানুষ বৈঠকে এবং সাংবাদিক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বলেই মুখ্যমন্ত্রীর আসনের প্রেক্ষাপটে জাতীয় পতাকা রাখা হয়েছিল। তার বেশি কিছু নয়। তবে একইসঙ্গে তাঁরা জানাচ্ছেন, এ ভাবে প্রেক্ষাপটে জাতীয় পতাকা রেখে সাংবাদিক বৈঠকের ঘটনা এর আগে ঘটেনি।
রাজনৈতিক মহলের একাংশের অবশ্য দাবি, প্রেক্ষাপট বদল আচমকা নয়। বাংলায় বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল জয়ের পরে শক্তির বিচারে গোটা দেশেই বিজেপি বিরোধী প্রধান মুখ হয়ে ওঠার ফলিত রূপই এর কারণ। রাজ্যের ক্ষমতা দখলের পাশাপাশি মমতা এখন জাতীয় স্তরের রাজনীতিতেও নির্ণায়ক ভূমিকা নিচ্ছেন। মোদীর বিরোধী শক্তিদের এক মঞ্চে নিয়ে আসার বিষয়ে আগের চেয়েও বেশি সক্রিয় হয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। দিল্লি সফরে তৃণমূল সাংসদদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন মমতা। দলের রাজ্যসভা সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায়ের বাড়িতে ওই হাজির ছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেরেক ও’ব্রায়েন-সহ দলের লোকসভা ও রাজ্যসভা সাংসদেরা। সেই বৈঠকের শেষে সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরিই বলেছিলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমরা প্রধানমন্ত্রী পদে দেখতে চাই। এখন দেশের মধ্যে তিনিই বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের প্রধান মুখ। তাঁর নেতৃত্বেই বিজেপি-কে হঠানো সম্ভব। দলের সংসদীয় কমিটির বৈঠকে আমরা সব সাংসদ মিলে সেই প্রস্তাবই দিয়েছি। আমরা তাঁর নেতৃত্বেই কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে নরেন্দ্র মোদী সরকারকে উৎখাত করতে চাই।’’
কল্যাণের ঘোষণা এবং দেশের বিভিন্ন রাজ্যে তৃণমূলের সংগঠন বিস্তারের কথা ভাবলে তার সঙ্গে বৃহস্পতিবার নবান্নের প্রেক্ষাপটের একটা সংযোগ রয়েছে বৈকি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy