—ফাইল চিত্র।
হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্যে নির্বাচনে হারের পর দিল্লিতে বসা বিরোধী মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে কার্যত কোণঠাসা হয়েই থাকতে হয়েছিল কংগ্রেসকে। জোটের আসন রফা নিয়ে ‘মতানৈক্য’ এবং রাহুল গান্ধী ও সনিয়া গান্ধীর সামনেই প্রধানমন্ত্রী-মুখ হিসাবে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গের নাম প্রস্তাব করে জোটের অন্দরে বহু প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আপ নেতা অরবিন্দ কেজরীওয়ালেরা। বাংলাতেও আসন ছাড়াছাড়ি নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের টানাপড়েন লেগে রয়েছে। এ সবের জেরে অচিরে বিরোধী ঐক্যে চিড় দেখা দেবে কি না, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই চর্চা শুরু হয়েছে জাতীয় রাজনীতির অলিন্দে। এই পরিস্থিতিতে ‘ইন্ডিয়া’-জটের দায় মমতার ঘাড়েই চাপিয়ে দিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। কংগ্রেস সাংসদের তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, ‘‘দিদিই তো জোটের ভবিষ্যৎ নস্যাৎ করে দিচ্ছেন। দিদিই চান না, জোট হোক। কারণ জোট হলে তাঁর অসুবিধা আছে।’’
এ নিয়ে কংগ্রেসকে পাল্টা বিঁধেছে তৃণমূল। দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘ওঁর মুখে এ সব কথা মানায় না। ২০২১ সালে সিপিএমের সঙ্গে জোট করে শূন্য পেয়েছিল। যাঁর ইস্তফা দিয়ে চলে যাওয়ার কথা, তিনি এখন বড় বড় কথা বলছেন।’’
বিরোধী জোটের আসন সমঝোতার প্রশ্নে মমতা প্রথম থেকেই সওয়াল করে এসেছেন, যে রাজ্যে যে দল বেশি শক্তিশালী, তারাই সংশ্লিষ্ট রাজ্যে জোটের ‘নিয়ন্ত্রক’ হবে। ফলে তৃণমূল চায়, বাংলায় তাদের হাতেই জোটের ‘নিয়ন্ত্রণ’ থাকুক। গত বৃহস্পতিবার উত্তর ২৪ পরগনার চাকলায় সেই বিষয়টি আরও স্পষ্টও করে দিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। মমতা কখনও কোথাও প্রকাশ্যে বলেননি, বাংলায় জোট হবে না। কিন্তু তিনি ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছেন, সারা দেশে ‘ইন্ডিয়া’ যেমন লড়াই করছে, তেমনই করবে। কিন্তু বাংলায় তৃণমূলই জোটের ‘চালিকাশক্তি’। অর্থাৎ, তাঁর দল একার ক্ষমতাতেই বিজেপিকে হারাতে সক্ষম। শনিবার অধীরও একই কাজ করলেন। তিনিও দাবি করলেন, বাংলায় কংগ্রেসও একার ক্ষমতায় বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে পারে। বহরমপুরের সাংবাদিক সম্মেলনে সাংসদ বলেন, ‘‘তৃণমূল তৃণমূলের মতো করে লড়ছে। আমরা আমাদের মতো করে চলছি। এই মুর্শিদাবাদে তৃণমূল-বিজেপিকে এক বার নয়, বার বার হারিয়েছি। আবার হারাব। কংগ্রেসের যেখানে নিজের ক্ষমতা রয়েছে, কংগ্রেস সেখানে একাই লড়বে’’
অনেকের মতে, রাজ্যে যদি শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে আসন নিয়ে আলোচনা হয়, তা মাথায় রেখেই আগে থেকে ‘চাপ’ তৈরি করে রাখতে চেয়েছেন মমতা। শনিবার অধীরও আসলে পাল্টা চাপ তৈরি করতে চাইলেন।
গত প্রায় এক মাস ধরে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট নিয়ে নানাবিধ সম্ভাবনার কথা শোনা গিয়েছে। রাহুল গান্ধীর সঙ্গে তাঁর ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠক নিয়ে কথা হয়েছিল বলে নিজেই জানিয়েছিলেন মমতা। তার পরেই কংগ্রেসের সূত্রে জানা গিয়েছিল, রাহুলের সঙ্গে মমতার তিনটি আসন ছাড়ার বিষয়ে কথা হয়েছে। আগের বারের জেতা বহরমপুর, মালদহ দক্ষিণ ছাড়াও রায়গঞ্জ আসনটি তাদের ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস মমতা দিয়েছিলেন বলে দাবি করা হয়েছিল দিল্লি কংগ্রেসের সূত্রে। তার পরে গত ১৯ ডিসেম্বর ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকের পরের দিনই কংগ্রেস হাইকমান্ড বাংলার নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন। সেখানে অবশ্য বঙ্গ কংগ্রেসের সিংহভাগ নেতাই তৃণমূলের সঙ্গে জোটের বিষয়ে আপত্তি জানান। সেই আবহে আবার বুধবার মালদহ দক্ষিণের কংগ্রেস সাংসদ আবু হাসেম খান চৌধুরী (যিনি ডালু বলেও পরিচিতি রাজ্য-রাজনীতিতে) দাবি করেন, মমতা তাঁদের কথা দিয়ে দিয়েছেন যে, গত বারের জেতা দু’টি আসন ছাড়বেন। পাশাপাশি, আরও কিছু আসন নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে ডালু এ-ও জানিয়েছিলেন যে, ওই দু’টি আসন ছাড়ার বিষয়টি তিনি সংবাদমাধ্যম মারফত জেনেছেন। ডালুর সেই বক্তব্য নিয়ে জল্পনার মধ্যেই মমতা জানিয়ে দেন, বাংলায় তৃণমূল নিজের ক্ষমতাতেই বিজেপিকে ‘শিক্ষা’ দিতে পারে!
তৃণমূলের একাংশের দাবি, আসন রফার প্রশ্নে ‘নিয়ন্ত্রণ’ নিজের হাতে রাখতে চাইলেও বাংলায় জোট নিয়ে কখনওই ‘কঠোর’ মনোভাব নিয়ে চলতে দেখা যায়নি মমতাকে। বরং, সাম্প্রতিক সময়ে তাঁকে যথেষ্টই ‘নমনীয়’ দেখিয়েছে। তিনি শুধু বোঝাতে চেয়েছেন, সব দলকে বাস্তবতা বুঝে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে এগোতে হবে। কোনও ‘অহং’ রাখলে চলবে না। এমনকি বামেদের প্রসঙ্গেও মমতার মন্তব্য, ‘‘আমি তো কাউকে জোর করতে পারি না। ওরা (বামেরা) কী করবে, সেটা ওদের বিষয়।’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম অবশ্য স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তাঁদের লড়াই বিজেপির পাশাপাশি তৃণমূলের বিরুদ্ধেও। অধীরের বক্তব্যও কার্যত এক। তিনিও বললেন, ‘‘কে এল আর কে গেল, তার ধার ধারি না!’’
রাজ্য-রাজনীতির বৃত্তের একাংশের মতে, আসলে বঙ্গ কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতাই রাজ্যে তৃণমূলের সঙ্গে জোটের বিপক্ষে। সে কথা তাঁরা দিল্লির নেতাদেরও বুঝিয়ে দিয়েছেন। দিল্লিতে জোট-বৈঠকের পর বাংলার নেতারা দলের হাই কমান্ডকে তৃণমূল নিয়ে ‘অ্যালার্জি’র কথা বলতে গিয়ে যে সব যুক্তি দিয়েছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম— তৃণমূলের বার বার কংগ্রেসে ভাঙন ধরানোর প্রবণতা। বঙ্গনেতাদের দাবি, বাংলায় বিজেপির থেকে তৃণমূল অনেক বেশি ক্ষতি করেছে কংগ্রেসের। ২০০৯ সালের লোকসভা আসন থেকে শুরু করে ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোট, কংগ্রেসের ক্ষতি করেই রাজ্যে আড়ে-বহরে বেড়েছে তৃণমূল। রাজ্যের নেতারা সেই ঝুঁকি আর নিতেই চান না। রাজ্যে দলের বাস্তবতা দেখেই এমনই মন্তব্য করছেন অধীর। বহরমপুরের সাংসদের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে মুর্শিদাবাদ জেলা তৃণমূলের সভাপতি অপূর্ব সরকার বলেন, ‘‘অধীরবাবু বিজেপির দয়ায় ভোটে জেতেন। তাই উনি চাইলেও বিজেপির বিরুদ্ধে যেতে পারবেন না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy