সরকারি অনুষ্ঠানে মমতা। শিলিগুড়ির সার্কাস ময়দানে। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক
দুর্গাপুর থেকে বিমানে সরাসরি সিঙ্গাপুর!
এই চমকপ্রদ ঘোষণা খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সোমবার শিলিগুড়ির সার্কাস ময়দানে সরকারি সভামঞ্চে তিনি জানান, কোচবিহার থেকে বিমানে দুর্গাপুর গিয়ে সরাসরি সিঙ্গাপুর অথবা কুয়ালা লামপুরে পৌঁছনো যাবে।
শুভারম্ভের দিনক্ষণও প্রায় বলেই দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, নভেম্বরের পরেই দুর্গাপুর-সিঙ্গাপুর উড়ান চালু হবে। এবং অদূর ভবিষ্যতে দুর্গাপুর থেকে ব্যাঙ্কক আর কুয়ালা লামপুরের উড়ানও ধরা যাবে! কোচবিহার-দুর্গাপুর-কলকাতা রুটে খুব শীঘ্রই সপ্তাহে চার দিন বিমান চলাচল শুরু হবে বলে জানানো হয়েছে। সেই সুবাদে উত্তরবঙ্গবাসীরা সহজেই দুর্গাপুর হয়ে সিঙ্গাপুর-সহ বিভিন্ন দেশে যেতে পারবেন।
কিন্তু আকাশে উড়বেন কি, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা শুনে কার্যত আকাশ থেকে পড়েছেন বিমান সংস্থার কর্তারাই! জেট এয়ারওয়েজ জানাচ্ছে, আগামী তিন বছরের মধ্যে কলকাতা থেকেই সিঙ্গাপুরে উড়ান চালানোর পরিকল্পনা নেই তাদের। দুর্গাপুর নিয়ে তো চিন্তাভাবনার অবকাশই নেই। কোচবিহারে উড়ান চালানো যায় কি না, সেই সমীক্ষা করেছে তারা। সমীক্ষার ফল বলছে, সেখানে ছোট বিমান চালালেও যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত যাত্রী পাওয়া যাবে না। ফলে তা বাণিজ্যিক ভাবে সফল হবে না।
ইন্ডিগো ছোট বিমান চালায় না। তাই কোচবিহার থেকে তাদের উড়ান শুরু করার প্রশ্নই ওঠে না। দুর্গাপুর থেকেও উড়ান চালানোর পরিকল্পনা নেই তাদের। দুর্গাপুর-সিঙ্গাপুর রুটে উড়ান নিয়ে প্রশ্ন করায় সংস্থার এক কর্তা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, “এমন অদ্ভুত একটা রুটে বিমান চালাতে কেউ রাজি হয়েছে নাকি!”
এয়ার ইন্ডিয়ার মুখপাত্র জানান, কোচবিহার বা দুর্গাপুর থেকে উড়ান চালানোর কোনও নির্দেশ পাননি তাঁরা। এই নির্দেশ সাধারণত বিমান মন্ত্রকের কাছ থেকে আসার কথা।
আর স্পাইসজেটের কেউ এই বিষয়ে মুখই খুলতে চাননি।
হতবাক উত্তরবঙ্গের বণিকমহলের অনেকেই। তাঁদের প্রশ্ন, রাজ্য সরকার ভর্তুকি দিলেও নিয়মিত সিঙ্গাপুর বা কুয়ালা লামপুর তো দূরের কথা, দুর্গাপুরে যাতায়াতের যাত্রী মিলবে কি? কী কারণে কোচবিহার থেকে বিমানে নিয়মিত দুর্গাপুর যাতায়াতের প্রয়োজন হবে, সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না। কোচবিহার তামাক ও পাটের অন্যতম বাণিজ্য ক্ষেত্র। কিন্তু দুর্গাপুরে ওই দুই শিল্পের কোনও কারখানা নেই। কোচবিহারে পর্যটন ক্ষেত্রেও এমন কোনও বড় পরিবর্তন আসেনি যে, রাতারাতি পর্যটক-সংখ্যা বেড়ে যাবে। সে-ক্ষেত্রে ওই বিমান পরিষেবা চালু হলেও যাত্রীর অভাবে তা আদৌ লাভের মুখ দেখবে কি না, তা নিয়েই সন্দিহান বণিকমহলের একাংশ। নর্থ বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের প্রধান উপদেষ্টা সমরেন্দ্রপ্রসাদ বিশ্বাস বলেন, “রাজ্য সরকার শিল্প পরিকাঠামো তৈরিতেই মনোযোগ দিল না। তাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসার তো দূরের কথা, জাতীয় স্তরের শিল্পেও উত্তরবঙ্গ সে-ভাবে পরিচিত হয়ে উঠতে পারল না। এই অবস্থায় শুধু বিমান যোগাযোগের ব্যবস্থা করে হবেটা কী?”
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় হতবাক পর্যটন পরিচালকেরাও। তাঁদের বিস্ময়ের সঙ্গে ক্ষোভও মিশে গিয়েছে। পাহাড়ের ট্যুর অপারেটরদের একাংশের মতে, সড়কই এখনও ঠিক হয়নি। সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ হয় না পর্যটন কেন্দ্রগুলির। মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি ডুয়ার্স গিয়ে দু’-দু’টি বাংলোর হাল দেখে কর্তাদের ভর্ৎসনা করেছিলেন। প্রচণ্ড গরমে লোডশেডিংয়ের জেরে পর্ষদের দু’জন ইঞ্জিনিয়ারকে সাসপেন্ডও হতে হয়। পর্যটনের পরিকাঠামোই নেই। এই অবস্থায় দেশ-বিদেশের বিমান পরিষেবা চালু হলেই সাড়া মিলবে, এটা মানতে পারছেন না ট্যুর অপারেটরদের একাংশ।
যে-দু’টি বিমানবন্দর ঘিরে মুখ্যমন্ত্রীর এ-হেন অভিনব উড়ানের পরিকল্পনা, তাদের হাল কী?
কোচবিহার বিমানবন্দরের দুর্বল পরিকাঠামোর কথা মুখ্যমন্ত্রীর অজানা নয়। তিনিই জানান, ওখানে রানওয়ে আছে মাত্র ১০৬৯ মিটার। বিমানবন্দর সূত্রের খবর, এই পরিকাঠামোয় সর্বাধিক ১৮ আসনের বিমান চালানো সম্ভব। তাই রানওয়ের দৈর্ঘ্য ৪৬০ মিটার বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। লাগোয়া এলাকায় গাছ, জলের ট্যাঙ্ক ও বহুতলের উচ্চতা কমানো হবে। রানওয়ে বাড়ানোর জন্য রাজ্য ২৫ কোটি টাকা দেবে। বিমানবন্দর-কর্তৃপক্ষের রিজিওনাল এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর শুদ্ধসত্ত্ব ভাদুড়ী বলেন, “সেই কাজ শেষ হতে এখনও দু’বছর লাগবে।”
দুর্গাপুর বিমানবন্দরের অবস্থাও তথৈবচ। রানওয়ের উপর থেকে বিদ্যুতের হাইটেনশন তার সরানো যায়নি এখনও। আর ওই তার না-সরালে বিমানবন্দরে বিমান ওঠানামার ছাড়পত্রই পাওয়ার কথা নয়। কবে ওই লাইন সরানো হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। ওখানকার কর্তাদের দাবি, চলতি বছরের শেষে বিমানবন্দর চালু হয়ে যাবে। তবে কোনও বিমান সংস্থা দুর্গাপুর থেকে উড়ান চালাবে বলে এ-পর্যন্ত ইচ্ছা প্রকাশ করেনি।
উড়ান শুরু করলেও তা দীর্ঘস্থায়ী করার ক্ষেত্রে যে সমস্যা আছে, এ দিনের সভায় তা মেনে নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “কোনও নতুন ব্যবসার শুরুতেই লাভ হয় না। প্রথমে কিছু দিন ভর্তুকি দিতে হয়। তাই আমরা ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” সরকারি সূত্রের খবর, আপাতত রাজ্যের উদ্যোগে ছোট ১০ আসনের বিমান চালানো হবে। তার জন্য আগ্রহপত্র চাওয়া হয়েছে। সরকারের আশা, ১০ আসনের বিমান রয়েছে, এমন সংস্থা সপ্তাহে দু’দিন কোচবিহার-দুর্গাপুর-কলকাতা রুটে উড়ান চালাতে এগিয়ে আসবে। আরও দু’দিন ওই বিমান বাগডোগরা ঘুরে চলাচল করবে। এই বিমান চালানোর ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার এবং দুর্গাপুরের বিমানবন্দর সংস্থা যৌথ ভাবে ভাড়ার ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দেবে। আর সরকারি অফিসারদের মতে, দুর্গাপুর থেকে সিঙ্গাপুর উড়ান চালানো মানে কলকাতা ঘুরে যাওয়ার কথাই বোঝাতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
এয়ার ইন্ডিয়া, স্পাইস, ইন্ডিগো, জেট কারও কিন্তু ১০ আসনের ছোট বিমান নেই। যাদের আছে, তারা সকলেই দিল্লি-মুম্বই-বেঙ্গালুরুর সংস্থা। সেখানে তারা বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থাকে ওই সব ছোট বিমান নিয়মিত ভাড়া দেয়। প্রশ্ন উঠেছে, সেই সব ভাড়া ছেড়ে তারা এই রাজ্যে এসে কোচবিহার-দুর্গাপুর থেকে উড়ান চালাতে রাজি হবে কেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy