Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪

বাঙালি জীবনে লুঙ্গি কোনও সম্প্রদায়ের একচেটিয়া নয়

প্রধানমন্ত্রী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইদানীং রোজ তোপ দেগে বলছেন, ‘পোশাক’ দেখেই হাঙ্গামাকারীদের চিহ্নিত করা যায়।

আলাপচারি: নিজের বাড়িতে জ্যোতি বসু। ফাইল চিত্র

আলাপচারি: নিজের বাড়িতে জ্যোতি বসু। ফাইল চিত্র

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৪:১৯
Share: Save:

‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবির আউটডোর শুটিং চলছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিলিখন— ‘‘বৌদি (বিজয়া রায়) তাড়াহুড়োয় মানিকদার (সত্যজিৎ রায়) ব্যাগে পাজামা দিতে ভুলে গেছেন।...আমার একটা বিশাল বড় বার্মিজ লুঙ্গি ছিল।... বললাম...আপনি পরবেন? মানিকদা সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাব খারিজ করে দিলেন।...মধ্যরাতে দেখি ছোটরা যেমন বড়দের ডাকে সেই রকম প্রায় ভয়ে ভয়ে ডাকছেন, সৌমিত্র, তোমার সেই লুঙ্গিটা আছে?’’

প্রধানমন্ত্রী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইদানীং রোজ তোপ দেগে বলছেন, ‘পোশাক’ দেখেই হাঙ্গামাকারীদের চিহ্নিত করা যায়। গেরুয়া শিবির সেই শুনে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘লুঙ্গি‌’কে বিঁধে ছড়িয়ে চলেছে লাগাতার বিদ্বেষমূলক প্রচার। জনসভার মঞ্চ থেকে বিজেপি রাজ্য সভাপতিকে বলতে শোনা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ‘লুঙ্গি ডান্স’ চলছে! অথচ দক্ষিণ ভারতে লুঙ্গি বা মুন্ডু যেমন সর্বজনীন, বাঙালি জীবনেও লুঙ্গি কোনও সম্প্রদায়ের একচেটিয়া ছিল না কোনও কালে। ছাপোষা বাঙালি লুঙ্গি পরে সকালের খবরের কাগজে চোখও রেখেছেন, থলি হাতে বাজারেও গিয়েছেন। আম গৃহস্থ থেকে শিল্পী-সাহিত্যিক-রাজনীতিক, লুঙ্গিকে আপন করে নিয়েছেন সকলেই।

সৌমিত্র নিজের বার্মিজ লুঙ্গির কথা লিখেইছেন। প্রয়াত অভিনেতা, বাংলা ছবির অন্যতম ফ্যাশন আইকন বসন্ত চৌধুরীর কনিষ্ঠ পুত্র সঞ্জিত চৌধুরী জানালেন, ‘‘বাবারও বার্মিজ লুঙ্গি ছিল। খাস আরাকান থেকে আনানো। বাড়িতে প্রায়ই পরতেন।’’

প্রখ্যাত প্রবীণ সাহিত্যিক মনে করতে পারলেন, সল্টলেকের বাড়িতে দেখা করতে গেলে লুঙ্গি পরেই স্বচ্ছন্দে কথাবার্তা বলতেন জ্যোতি বসু। তাঁর নিজের জীবনেও লুঙ্গি অপরিহার্য। বললেন, ‘‘মাপের ঝামেলা নেই, টেঁকসই, বড় সুবিধেজনক পোশাক।’’ নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তীর মনে পড়ল, শম্ভু মিত্র বাড়িতে সাধারণত একরঙা লুঙ্গিই পরতেন। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চের কস্টিউম পরার আগে লুঙ্গি পরেই মেকআপ নিতেন।

কলেজ স্ট্রিটের প্রবীণ প্রকাশক সবিতেন্দ্রনাথ রায় বলছিলেন, সৈয়দ মুজতবা আলি একবার ওঁকে বলেছিলেন, ব্রহ্মদেশের বৌদ্ধদের দেখেই কিন্তু আরবে লুঙ্গির প্রচলন।

দেবব্রত বিশ্বাস।

সেখান থেকে কন্দহর-গজনি হয়ে ভারতে লুঙ্গির প্রবেশ। আবার জি এস ঘুরে-র বিখ্যাত বই ‘ইন্ডিয়ান কস্টিউম’ ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, ভারতে ‘লুঙ্গি’র প্রচলন ছিল ইসলামের আগমনের অনেক আগে থেকেই। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই ছিল এই পোশাক। প্রাচীন মন্দির ভাস্কর্যে তার নিদর্শন অজস্র।

বাঙালির জীবনে গরমের সময় আরামদায়ক পোশাক হিসেবে লুঙ্গির আদর খুব। যামিনী রায়ের পৌত্র, তথ্যচিত্রনির্মাতা দেবব্রত রায় বললেন, ‘‘দেবব্রত বিশ্বাসকে লুঙ্গি ছাড়া ভাবাই যেত না। ছোটবেলায় নাকতলার বাড়ির বারান্দায় লুঙ্গি পরে বসে থাকতে দেখতাম ছবি বিশ্বাসকে। চিত্রশিল্পী নীরদ মজুমদারকে দেখেছি, লুঙ্গি পরে লেকে সাঁতার কাটতে যাচ্ছেন!’’

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

দক্ষিণাপণের বিপণিতে ঘুরে বাটিকের লুঙ্গি, কটকি লুঙ্গি, সিল্কের লুঙ্গি— সবেরই খোঁজ মিলল। দোকানিরা জানালেন, বারমুডা প্রজন্ম লুঙ্গি পরে না তেমন। কিন্তু প্রবীণদের জন্য লুঙ্গি কেনার চল এখনও দিব্যি আছে। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বাড়িতে চিরকাল লুঙ্গিই পরেছেন। এখনও তা-ই পরেন। প্রবীণদের স্মৃতি বলছে, বিশ্বযুদ্ধের কলকাতায় কাপড়ের রেশনের সময়ে বহু বাড়িতে পুরুষরা মেয়েদের শাড়িকে লুঙ্গির মতো করে পরতেন। ধুতিকে লুঙ্গির মতো করে পরার রেওয়াজও বহুল। সবিতেন্দ্রনাথ বললেন, ‘কিরীটি’র স্রষ্টা নীহাররঞ্জন গুপ্ত ওই রকম লুঙ্গির মতো করে ধুতি পরতেন। তা ছাড়া ‘‘প্রবোধকুমার সান্যাল, প্রমথনাথ বিশী, বনফুল, গজেন্দ্রকুমার মিত্ররা বাড়িতে লুঙ্গিই পরতেন। বিমল মিত্রকেও মাঝে মাঝে লুঙ্গি পরতে দেখেছি।’’ গেরুয়া শিবিরের মিম-নির্মাতারা জানেন না নির্ঘাৎ, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পছন্দের আটপৌরে পোশাক ছিল লুঙ্গি। ‘ভারতমাতা’র ছবি হয়তো বা সেই পোশাক পরেই আঁকা!

অন্য বিষয়গুলি:

Lungi CAA West Bengal Bengali Culture
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy